দুবাইয়ের শাসক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া শেখ মোহাম্মদ আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে দুবাই পুলিশের প্রধানের পদে ছিলেন। শেখ রাশেদ বিন সাইদ আল মাকতুমের তৃতীয় পুত্র তিনি। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির কেন্দ্রে থাকা আমিরাতের ভাইস-প্রেসিডেন্টও এই শেখ মোহাম্মদ, সঙ্গে দুবাইয়ের শাসকও তিনি। তার বর্তমান ও সাবেক মিলে ছয় জন স্ত্রী রয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এ ছয় স্ত্রীর ঘরে তার রয়েছে ৩০ জন সন্তান। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ ধনকুবের এই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিজীবনের নানা দিক উঠে এসেছে তার নিজের লেখা  ‘কিস্সাতি’ (আমার গল্প) বইটিতে। পঞ্চাশ পর্বে সে গ্রন্থ থেকেই নানা দিক তুলে এনেছেন মুহাম্মাদ শোয়াইব। আজ থাকছে নবম পর্ব। 


১৯৬১ সালের ৮ এপ্রিল রাত। নিজের ঘরে আমি ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভাঙল আমার। প্রচণ্ড বাতাসে আমার ঘরের জানালার পাল্লাগুলো খুলছিল আর বন্ধ হচ্ছিল।      

আমি শুনতে পেলাম আমার বাবা আমাকে ও আমার ভাইদের ডাকাডাকি শুরু করেছেন। বাতাসের তীব্রতায় তখন আমাদের ঘরের দরজা খুলে গেছে। সেটিকে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার মা ও বোন শক্ত কোনো কাঠ খুঁজছিলেন; যাতে সেটার সাহায্যে দরজা কোনোভাবে বন্ধ রাখা যায়। 

আশপাশ থেকে ভারী জিনিসপত্রগুলো এনে আমরা দরজার সামনে রাখতে শুরু করি। কিন্তু ঝড় তখন এত তীব্র যে দরজা ভেঙে পড়ার উপক্রম।   

এ রাতটা একেবারে অন্যরকম ছিল। এ রাতের শুরু তো ছিল, কিন্তু শেষ আর হচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর, ঝড়ের বেগ কিছুটা কমে এলে অনেকে আমাদের বাড়ির দিকে ছুটে আসেন। তাদের ভয় ছিল আমার বাবাকে নিয়ে।

সেদিন যারা আমাদের বাড়ির দিকে ছুটে এসেছিলেন তাদের সবার জন্য দরজা উন্মুক্ত ছিল। যত মানুষের জায়গা হয়েছে, সবাই আমাদের ঘরে ঢুকেছেন। আকস্মিক ওই ঝড়কে মুরব্বিরা কেয়ামতের সাথে তুলনা করছিলেন। 

ঝড়ের পর যারা এসেছিলেন তাদের সবার মুখেই ছিল ঝড়ের ভয়াবহতার গল্প। কেউ কেউ দিচ্ছিলেন তাদের প্রিয়জনকে হারানোর বিবরণ।   

আমার মনে আছে ওই রাতে এক নারী আমার মায়ের কাছে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি ভয়ে কথা বলতে পারছিলেন না। আমাদের ঘরে আশ্রয় নেওয়া কয়েকজন আহত ব্যক্তির চিকিৎসায় এগিয়ে আসেন আমার মা ও বোন। 

অষ্টম পর্ব : ১৮৫ বছরের পরিশ্রমের ফসল আজকের দুবাই

বাড়িতে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা যাতে ভয় না পান সে জন্য খুব গোপনে আমার বাবা ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসাব করা শুরু করলেন। চারপাশ থেকে শুধু ক্ষয়ক্ষতির চিত্র উঠে আসছিল। শিশুদের খেলনার মতো করে উড়ে গিয়েছিল খেজুর গাছগুলো, জেলেদের নৌকাগুলো উঠে এসেছিল শহরের রাস্তায়। মারা গিয়েছিলেন বহু মানুষ, আহত ছিলেন অসংখ্য।  

পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে আমার বাবা সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দিলেন। পুরুষদের আলাদা করে ফেলে তাদের অনেক দায়িত্ব দিলেন। পুরুষদের প্রথম যে দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছিল তা হলো ঘরে ঘরে আহতদের জন্য ওষুধ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। 
 
ভয়ঙ্কর এ পরিস্থিতির মধ্যে আমার বাবা শুনলেন আরও এক বিপদের কথা; যা শুনে তিনি রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান। কয়েকজন ব্রিটিশ সৈন্য ছুটতে ছুটতে আমাদের ঘরে এসে ঢুকলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে তারা বাবাকে খবর দিলেন- দারা নামের জাহাজটিতে আগুন ধরেছে।  

এমভি দারা ব্রিটিশ শিপিং সংস্থার মালিকানাধীন একটি জাহাজ ছিল। প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে দারার নিচে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে। আর তা থেকেই আগুন ধরে যায় জাহাজে।  

দুর্ঘটনার সময় আটশোর বেশি যাত্রী ছিলেন জাহাজে। জাহাজে থাকা যাত্রীদের অনেকে মারা যান আগুনে পুড়ে, আবার অনেকে মারা যান পানিতে ডুবে। কিছু নৌকা ওই জাহাজে থাকা যাত্রীদের উদ্ধারে এগিয়ে যায়, কিন্তু বাতাসের কারণে তারা কোনোভাবেই স্থির হতে পারছিল না।    

আরও জোরালোভাবেব উদ্ধার কাজ চালানোর জন্য আমার বাবা আমাদের পরিবারের বহু সদস্যকেও পাঠান। আমরা প্রায় ৫০০ জনকে উদ্ধারও করি। দেখে মনে হচ্ছিল এ উদ্ধার তৎপরতা বোধহয় কোনোদিন শেষ হবে না।  

সবকিছু মিলিয়ে দুবাইয়ের আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল। মৃতের সংখ্যা ছিল হতবাক হওয়ার মতো। এমন কোনো বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, যেখানে একজন না একজন মারা যাননি। আমার বাবা তার পক্ষ থেকে সব কিছু করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু যারা স্বজন হারিয়েছেন, তাদের সেই স্বজন ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তো বাবার ছিল না।  

আমি কখনোই প্রকৃতিকে অবমূল্যায়ন করতে শিখিনি। যেকোনো সময় যেকোনো জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে শিখেছি। ঝড়ের ওই তাণ্ডবের মধ্যে আমরা দেখেছি একজন নেতা এতবড় সংকটেও কিভাবে নেতৃত্ব দেন। 

যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়েছিল তা হলো সেদিনের সেই উদ্ধার অভিযান। উত্তাল সমুদ্রে সেদিন সাধারণ মানুষের আগে আমাদের ও আমাদের চাচাতো ভাইদের পাঠিয়েছিলেন আমার বাবা।  

যেকোনো বিপদেই আসলে প্রকৃত পুরুষরা তাদের ভেতরে লুকানো আসল ক্ষমতা দেখায়। 

এনএফ