বাংলাদেশি নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ভারতে থাকার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। আর এই পারমিটের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করলেও কোনও সাড়া পাননি তিনি। যে কারণে দেশটিতে বসবাস করা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিস্তারিত এক পোস্টে এই তথ্য জানিয়েছেন তসলিমা নাসরিন।

তসলিমা নাসরিনের ভারতে বসবাসের জন্য নির্ধারিত রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২২ জুলাই। ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘‘লজ্জা লেখার পর থেকে নিন্দুকেরা আমাকে ‘বিজেপির লোক’, ‘আরেসেসের লোক’, ‘র’এর লোক বলে প্রচার করেছে। এও বলেছে আমাকে টাকা দেওয়া হয়েছে ‘লজ্জা’ লেখার জন্য। এরা কখনও ভাবতে পারে না, কেবল মানবাধিকারের জন্য মানুষ সংগ্রাম করতে পারে, কলম ধরতে পারে। টাকা পাওয়া তো দূরের কথা, মানবতার জন্য মানুষ নিজের পকেট থেকে অজস্র টাকাও খরচ করতে পারে।’’

নির্বাসিত এই লেখিকা ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের কারও সাথে তার সম্পর্ক নেই উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘নিন্দুকদের মিথ্যের ভিড়ে সত্যিটা হলো, আমি বিজেপি বা আরেসেস বা র’এর কাউকে চিনি না। কারও সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। সরকারের কেউই আমার চেনা নয়। আমি কারও সঙ্গে যে যোগাযোগ করবো জানার জন্য যে কেন আমার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে না, তার উপায় নেই। গুগল থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইমেইল ঠিকানা নিয়ে ইমেইল করেছি, তার কোনও উত্তর পাইনি।’’

ভারত মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কি না সেটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন, ‘‘যে দেশে দীর্ঘদিন ভালবেসে বাস করছি, নিশ্চিন্তে নিরাপদে বাস করছি, সে দেশ যদি বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে রাখে, তবে একশো একটা দুশ্চিন্তা এসে ভর করে। প্রায় তিন মাস হতে চললো, এখনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনও সিদ্ধান্ত আসছে না আমার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়াবে কি বাড়াবে না—এই ব্যাপারে। কার কী ক্ষতি আমি করেছি? জীবনভর পায়ের তলায় দাঁড়াবার মাটি পেলাম না। যে দেশে জন্মেছিলাম, কিছু সত্য উচ্চারণ করেছি  বলে সে দেশ নির্বাসন দিল, যে রাজ্যে ভাষার টানে আর প্রাণের টানে বাস করছিলাম, সে রাজ্যও অজ্ঞাত কারণে নির্বাসন দিল। আর  যে শহরে বাস করছি এখন, অন্য কোনও দেশে বাস করার কোনও উপায় নেই বলে, সে শহরও কি অবশেষে তল্পিতল্পা গুটোতে বলবে?’’

দিল্লিতে নিজের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার শিকার হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘এই শহরের এক ক্রিমিনাল ডাক্তার গত বছর আমাকে নিরীহ পেয়ে ম্যালপ্র্যাক্টিসের শিকার করেছে, সুস্থ শরীরকে টাকার লোভে পঙ্গু করে রেখেছে। দৌড় ঝাঁপ করার, দেশ বদলানোর, নতুন জায়গায় স্থায়ী হওয়ার শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক অবস্থাও আর নেই।’’

‘‘নির্বাসনের শুরু থেকে কম দেশে তো বাস করার চেষ্টা করিনি। এক দেশ থেকে আরেক দেশে শুধু হন্যে হয়ে ‘দেশ’ খুঁজে বেড়িয়েছি। পাইনি। যে দেশকে অনেকগুলো বছর ‘দেশ’ বলে ভেবে নিয়েছি, সে দেশও কি তবে আবার নির্বাসন দিতে চাইছে আমাকে? বিনা দোষে একজন লেখককে আর কতবার নির্বাসন দণ্ড দেবে ক্ষমতাবান মানুষেরা! এ যেন বার বার ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলার মতো। আমার কি যথেষ্ট মৃত্যু হয়নি?’’

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারকে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি কুড়ি বছর এই দেশে রয়েছি, এমনটা কখনও হয়নি। প্রত্যেক বার পারমিটের মেয়াদ ফুরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই তার পুনর্নবীকরণ করা হয়। কিন্তু এ বারে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।’’ নির্বাসিত এই লেখিকা বলেছেন, তার আমেরিকায় কাজ রয়েছে কিন্তু বার বার তা পিছিয়ে দিতে হচ্ছে। কারণ সেখানে গেলে কাগজের অভাবে আর ভারতে ঢুকতে পারবেন না।

এসএস