কফি, বিশ্বজুড়ে অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়, যা প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। এই কফি পানের পরিমাণ, অভ্যাস, এবং পছন্দের বিষয়ে একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ কিছু তথ্য, যা আধুনিক সমাজের কফি সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা সংস্থা ড্রাইভ রিসার্চ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ২০২৪ সালের বিশ্বব্যাপী কফি পানের প্রবণতা, ক্রেতাদের পছন্দ, স্বাস্থ্যগত চিন্তা, এবং অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে।

কফি পানের জনপ্রিয়তা: একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ

কফির ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং এর উৎপত্তি প্রায় ৯ম শতাব্দীর দিকে, আফ্রিকার ইথিওপিয়া থেকে। তারপর ধীরে ধীরে এটি আরব বিশ্ব, ইউরোপসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কফি শুধু স্বাদের জন্যই নয়, এর শক্তি বৃদ্ধিকারী উপাদানের জন্যও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আজকের দিনে, কফি দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে, যা ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি অফিস, ব্যবসায়িক আলোচনা, এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও অপরিহার্য।

২০২৪ সালের এই কফি সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিবেদনে ১,৩০০ জনেরও বেশি অংশগ্রহণকারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। গবেষণার প্রধান কিছু তথ্য নিম্নরূপ:

কফি পানের দৈনন্দিন অভ্যাস

৭৩% অংশগ্রহণকারী প্রতিদিন কফি পান করেন।

৩৬% অংশগ্রহণকারী দিনে গড়ে ৩ থেকে ৫ কাপ কফি পান করেন।

১০% অংশগ্রহণকারী দিনে ৫ বা তারও বেশি কাপ কফি পান করেন।

কফির প্রয়োজনীয়তা

৫৯% অংশগ্রহণকারী জানান যে তারা কফি ছাড়া সকাল শুরু করতে পারেন না।

৩২% অংশগ্রহণকারী দিনের শেষে বা রাতে কফি পান করেন, যা রাতের কাজ বা পাঠে মনোযোগ দিতে সাহায্য করে।

কফি এবং সামাজিকতা

৫১% অংশগ্রহণকারী অন্তত একবার সপ্তাহে কফি শপ থেকে কফি কেনেন।

৪৫% অংশগ্রহণকারী বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় কফি পান করতে পছন্দ করেন।

স্বাস্থ্যগত চিন্তা

৪৮% অংশগ্রহণকারী বিশ্বাস করেন যে কফি তাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

২২% অংশগ্রহণকারী ক্যাফেইন-ফ্রি বা ডিক্যাফ কফি পান করেন, যা ইঙ্গিত দেয় যে স্বাস্থ্যের জন্য সচেতনতা বাড়ছে।

কফির খরচ এবং বাজার চাহিদা

কফির বৈশ্বিক বাজার বিশাল। ২০২৪ সালের বাজার গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী কফির বাজার প্রায় ১০২.৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কফি শুধু একটি পানীয় নয়, এটি একটি প্রধান অর্থনৈতিক উপাদান হয়ে উঠেছে, যা বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

কফির খরচ সম্পর্কিত তথ্য

প্রতি মাসে গড় খরচ: ২৫% অংশগ্রহণকারী মাসে গড়ে ৫০ ডলারেরও বেশি কফিতে ব্যয় করেন।১৯% অংশগ্রহণকারী মাসে ১০০ ডলারের বেশি খরচ করেন, যা মূলত কফি শপ বা ব্র্যান্ডেড কফি কেনার ফলে ঘটে। তবে ৪৪% অংশগ্রহণকারী বাড়িতে কফি তৈরি করতে পছন্দ করেন, যা তাদের জন্য একটি সাশ্রয়ী এবং সুবিধাজনক বিকল্প।

যেসব কারণে কফি পান

গবেষণায় উঠে এসেছে কফি পানের পেছনে বিভিন্ন কারণ, যা মানুষের কফি পছন্দের উপর নির্ভর করে। নিচে কিছু প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো:

(১) সতেজতা বৃদ্ধি: বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী কফি পান করেন সতেজ অনুভব করতে এবং দিনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে।

(২) স্বাদ ও অভ্যাস: অনেক মানুষ কফি পান করেন শুধুমাত্র স্বাদের জন্য। এটি তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।

(৩) সামাজিকতা: কফি শপে কফি পান করা অনেকের জন্য একটি সামাজিক অভিজ্ঞতা, যেখানে তারা বন্ধুদের সাথে সময় কাটান।

(৪) কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ হ্রাস: কর্মস্থলে কাজের চাপ ও মানসিক চাপ কমানোর জন্য অনেকেই কফি পান করেন। কফির প্রভাব দ্রুত মনোযোগ ও কার্যকারিতা বাড়ায়।

কিছু জনপ্রিয় কফির ধরন

গবেষণায় বিভিন্ন ধরনের কফি সম্পর্কে মানুষের পছন্দের তথ্যও পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী নিম্নলিখিত কফি ধরনের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন:

এস্প্রেসো: শক্তিশালী এবং দ্রুত প্রস্তুত হওয়া কফি।

লাট্টে: মৃদু স্বাদের কফি, যেখানে দুধের ফেনা ব্যবহার করা হয়।

ক্যাপুচিনো: দুধ এবং এস্প্রেসোর মিশ্রণ।

ড্রিপ : বাড়িতে তৈরি করা সহজ এবং সাশ্রয়ী কফি।

কফির স্বাস্থ্য উপকারিতা

কফি সম্পর্কে অনেক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, এটি বিভিন্ন স্বাস্থ্যের সমস্যার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যারা নিয়মিত কফি পান করেন, তাদের মধ্যে অনেকেই কফির স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন। কফির কফির কিছু উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা হলো—

মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি: ক্যাফেইনের প্রভাবে মস্তিষ্কে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের মনোযোগ ও সচেতনতা বাড়ে।

বিপাকক্রিয়া বাড়ানো বৃদ্ধি: কফি বিপাকক্রিয়া বাড়ায়, যা ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে।

টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানো: গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত কফি পানের ফলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি প্রায় ২০-৩০% কমে।

লিভারের সুরক্ষা: লিভারের বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে কফি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।

কফি এবং পরিবেশ

কফির উৎপাদনের সাথে পরিবেশের প্রভাব সম্পর্কেও আলোচনা করা প্রয়োজন। কফি উৎপাদনের জন্য প্রচুর পরিমাণে জমি ও পানি ব্যবহার করা হয়। পরিবেশ সচেতনতার কারণে অনেক কফি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এখন টেকসই উৎপাদন এবং অর্গানিক কফি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন ফায়ারট্রেড এবং রেইনফরেস্ট অ্যালায়েন্স কফি উৎপাদনে পরিবেশগত দায়িত্ব নিশ্চিত করতে ভূমিকা পালন করছে। তারা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছে যাতে টেকসই কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।

কফির ভবিষ্যৎ: নতুন চাহিদা এবং উদ্ভাবন

গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আগামী বছরে কফির বাজারে নতুন প্রবণতা দেখা যাবে। কফি বাজারে কিছু উদ্ভাবন ও নতুন চাহিদার দিকে নজর দেয়া যেতে পারে:

ক্যাফেইন-ফ্রি কফির চাহিদা বৃদ্ধি: স্বাস্থ্য সচেতন গ্রাহকদের জন্য ডিক্যাফ কফি একটি জনপ্রিয় বিকল্প হয়ে উঠছে।

বিকল্প দুধের ব্যবহার: অনেক কফিপ্রেমিক দুধের পরিবর্তে অ্যালমন্ড, ওট বা সয়া দুধ ব্যবহার করছেন।

ঠান্ডা কফির জনপ্রিয়তা: ঠান্ডা কফি, বিশেষ করে আইসড কফি এবং কোল্ড ব্রু কফি, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

ড্রাইভ রিসার্চের ২০২৪ সালের বাজার গবেষণাটি কফি সম্পর্কে মানুষের অভ্যাস, পছন্দ, এবং অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে। কফি শুধু একটি পানীয় নয়, এটি আধুনিক জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্যগত উপকারিতা থেকে শুরু করে সামাজিকতা এবং কাজের চাপ কমানো পর্যন্ত কফি পানের বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যা মানুষের জীবনধারাকে প্রভাবিত করে। কফির বাজার ক্রমাগত বিকাশমান এবং নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে কফির ভবিষ্যৎও আশাব্যঞ্জক।

এআইএ/এসএমডব্লিউ