বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে দীর্ঘ এক প্রতিবেদন করেছে জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া। শেখ হাসিনা কীভাবে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে কীভাবে দেবতাতুল্য করে তুলেছিলেন এবং সাধারণ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে কীভাবে স্বৈরাচারী শাসন চালিয়ে গেছেন সেটিই এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

নিক্কেই এশিয়াকে এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, শেখ হাসিনার চারপাশে ছিল শুধু ‘ইয়েস ম্যান’। যারা তাকে ছাত্রদের কোটা আন্দোলন এবং দাবিদাওয়া নিয়ে সঠিক বার্তা দিতে পারেননি। অপরদিকে হাসিনা ধীরে ধীরে গত ১৫ বছরে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছেন।

সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনা ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন দেশের স্বাধীনতার মহানায়ক। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সেনা অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন। একই সঙ্গে হাসিনার মা ও ১০ বছরের ভাইসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে হত্যা করা হয়। কিন্তু ওই সময় হাসিনা ও তার বোন রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় বেঁচে যান। এরপর তারা ভারতে দীর্ঘসময় শরণার্থী হিসেবে থেকেছেন।

হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন এবং তার বাবার গঠিত আওয়ামী লীগের হাল ধরেন এবং দলকে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ওই নির্বাচনে হাসিনা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যান।

তবে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় পায় এবং হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর দুটি দলের মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল হয়।

কিন্তু ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন, বিরোধী দলকে দমন করেন এবং নিজের শাসনামল দীর্ঘ করেন।

জাপানি এই সংবাদমাধ্যমে কোটা আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে বলা হয়েছে, বেকারত্বে ভোগা সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটার বিরোধীতা করেন এবং আন্দোলন করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বিএনপির আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করে বল প্রয়োগ করেন হাসিনা। এরপর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়; হাসিনা শিক্ষার্থীদের রাজাকার হিসেবে উল্লেখ করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের উপর দমন-নিপীড়ন চালিয়ে হাসিনা চূড়ান্ত মূল্য দিয়েছেন।

এতে আরও বলা হয়েছে, “৪৩ বছর আগে স্বাধীনতার নায়কের কন্যা হিসেবে হাসিনাকে স্বতস্ফূর্তভাবে সবাই গ্রহণ করেন। কিন্তু এরপর তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়। সেটি তার জন্য চমকই ছিল।”

হাসিনা কেন এবং কীভাবে স্বৈরাচার ও বেপরোয়া হয়ে উঠলেন এ ব্যাপারে ‘জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনস ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনোমিকসের’ নির্বাহী সহ-সভাপতি মাইয়ুমি মুরাইয়ামা বলেছেন, “যখন ১৯৯৬ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসেন তখন তাকে আমার স্বৈরাচার রাজনীতিবিদ মনে হয়নি। ২০০৯ সালে দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল শেষে তিনি যখন ফের ক্ষমতায় আসেন তখন তার মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাব দেখা যায়।”

“হাসিনা সংবিধান সংশোধন করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন— যেটি বিরোধী দলে থাকার সময় তিনি নিজেই চেয়েছিলেন। এতে করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং তার একনায়কতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য আর কিছু থাকেনি।”

“তিনি নিশ্চিত করেন খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে যেন সাজা পান। এতে বিএনপি দুর্বল হয়ে যাবে। কিন্তু তার স্বেচ্ছাচারিতা শুধুমাত্র বিরোধী দলগুলোর উপরই থাকেনি। তিনি নিজের বাবাকে দেবতাতুল্য করে তুলেন এবং এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন যেখানে কোনো ধরনের সমালোচনাই সহ্য করা হতো না।”

তিনি জানিয়েছেন, নিজের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাকস্বাধীনতা হরণ করেছিলেন হাসিনা। এরপর যখন কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় তখন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিস্ফোরণ ঘটে।

এই বিশেষজ্ঞ বলেছেন, হাসিনার রাজনৈতিক জীবনে আরেকটি বড় ভুল ছিল তিনি তার একসময়ের মিত্রদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। একটা সময় কারও উপর ভরসা করতে পারতেন না। দিনশেষে হাসিনা শুধুমাত্র নিজের বোন শেখ রেহানাকেই বিশ্বাস করতেন।

তিনি বলেছেন, “তার চারপাশে ছিল ইয়েস ম্যান। এ কারণে সঠিকভাবেব তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি এবং চাওয়া বুঝতে পারেননি।”

সূত্র: নিক্কেই এশিয়া

এমটিআই