পাকিস্তানে এমপক্সে (মাঙ্কিপক্স) আক্রান্ত এক রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। ভাইরাসটির পশ্চিম আফ্রিকান ক্ল্যাড-২ ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন। সোমবার পাকিস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘যে ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটির যে ধরন শনাক্ত করা হয়েছে, সেটি ক্ল্যাড-২ নামে পরিচিত। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে এমপক্স ভাইরাসের মধ্য আফ্রিকান ধরন ক্ল্যাড-১ আক্রান্ত কোনও রোগী শনাক্ত হননি।

অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাস এমপক্সের ক্ল্যাড-১ ধরন ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের মাধ্যমে মানুষের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। এমপক্সের এই ধরনের কারণে বিশ্বজুড়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। গত সপ্তাহে ইউরোপের দেশ সুইডেনে এমপক্সের ক্ল্যাড-১ ধরনে আক্রান্ত একজন রোগীকে শনাক্ত করা হয়।

আফ্রিকায় এই ধরনের ক্রমবর্ধমান প্রাদুর্ভাবের সাথে সুইডেনে শনাক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে এমপক্সের ক্ল্যাড-১ ধরনে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় সুইডেনে।

পাকিস্তানের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাজিদ হুসাইন শাহ বলেছেন, পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত ক্ল্যাড-১ ধরনে আক্রান্ত কোনও রোগী শনাক্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। এই রোগের সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাবকে বিশ্বের জন্য উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

এর আগে, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে (ডিআর কঙ্গো) শনাক্ত হওয়া এমপক্স ভাইরাস প্রতিবেশি দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার পর গত সপ্তাহে ডব্লিউএইচও আফ্রিকায় প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করে।

গত বছরের জানুয়ারিতে প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে ডিআর কঙ্গোতে ২৭ হাজারের বেশি মানুষের শরীরে এমপক্স ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে এমপক্সে আক্রান্তদের মধ্যে এক হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন; যাদের বেশিরভাগই শিশু।

বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে সুইডেনে এমপক্সের নতুন ধরনের সংক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সুইডেনে শনাক্ত হওয়া এমপক্সের ক্ল্যাড-১ ধরনের সাথে আফ্রিকায় ক্রমবর্ধমান প্রাদুর্ভাবের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে তারা জানিয়েছেন; যা আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে এই ভাইরাসটির প্রথম কোনও সংক্রমণ। তবে ডব্লিউএইচও এমপক্সের বিস্তার রোধে কোনও ধরনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানায়নি।

• এমপক্স কী এবং এর লক্ষণগুলো কী?

গুটিবসন্তের একই গোত্রীয় ভাইরাস হলেও এমপক্স সাধারণত অনেক কম ক্ষতিকারক। প্রথমে এটি প্রাণী থেকে মানুষের দেহে স্থানান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু এখন এটি মানুষ থেকে মানুষেও ছড়ায়। এই রোগে আক্রান্তদের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ফোলা, পিঠে এবং পেশিতে ব্যথা।

আক্রান্ত ব্যক্তির একবার জ্বর উঠলে গায়ে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। সাধারণত মুখ থেকে শুরু হয়ে পরে হাতের তালু এবং পায়ের তলদেশসহ শরীরের অন্যান্য অংশে তা ছড়িয়ে পড়ে।

অত্যন্ত চুলকানো বা ব্যথাদায়ক এই ফুসকুড়িগুলো পরিবর্তন হয় এবং বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে স্ক্যাব বা গোল গোল পুরু আস্তরে পরিণত হয়ে শেষে পড়ে যায়। এর ফলে দাগ সৃষ্টি হতে পারে। সংক্রমণের ১৪ থেকে ২১ দিনের মধ্যে এটি নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যেতে পারে।

তবে ছোট শিশুসহ ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর জন্য কিছু ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত মারাত্মক। এর আক্রমণের কারণে গুরুতর ক্ষেত্রে মুখ, চোখ এবং যৌনাঙ্গসহ পুরো শরীরে ক্ষত তৈরি হতে পারে।

• এমপক্স কীভাবে ছড়ায়?

এমপক্স সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক, সরাসরি সংস্পর্শ কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি এসে কথা বলা বা শ্বাস নেওয়ার মতো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে এটি একজনের থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসটি ফাটা চামড়া, শ্বাসতন্ত্র বা চোখ, নাক বা মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

ভাইরাসে দূষিত হয়েছে এমন জিনিস যেমন বিছানা, পোশাক এবং তোয়ালে স্পর্শের মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে। বানর, ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালির মতো কোনো প্রাণী যদি এতে সংক্রমিত হয় আর কেউ যদি ওই সংক্রমিত প্রাণীর সঙ্গে বেশি কাছাকাছি আসে তবে তিনিও আক্রান্ত হতে পারেন।

২০২২ সালের বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাবের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। কঙ্গোর বর্তমান প্রাদুর্ভাবের বড় একটি কারণ আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।

ছোট শিশুসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের মধ্যে এমপক্স পাওয়া গেছে।

• সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কারা?

রোগের উপসর্গযুক্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যকর্মী এবং পরিবারের সদস্যসহ তার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা যে কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন।

কে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে সে সম্পর্কে আরও বুঝতে বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করছেন। তাদের মধ্যে অল্পবয়সী শিশুরা থাকতে পারে। কারণ একদিকে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, অন্যদিকে অঞ্চলটির অনেকরই পুষ্টির অভাব রয়েছে। ফলে রোগের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করা বেশি কঠিন হয়ে যায়।

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ছোট শিশুরা যেভাবে ঘনিষ্ট হয়ে খেলাধুলা করে এবং একে অপরের সঙ্গে মেশে তার কারণে ঝুঁকিতে থাকতে পারে। এমনকি চার দশকেরও বেশি সময় আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া গুটিবসন্তের টিকাও তারা পাচ্ছে না। ফলে আগের টিকা পাওয়ার কারণে বয়স্ক ব্যক্তিরা হয়তো কিছুটা সুরক্ষিত।

দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার যে কারোই, বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আরও বেশি ঝুঁকি রয়েছে। এর থেকে বাঁচতে এমপক্সে আক্রান্ত কারও সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ এড়িয়ে চলতে হবে এবং ভাইরাসটি যদি আশেপাশের কারও থাকে, তবে সাবান ও পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে।

সব ক্ষত সেরে না যাওয়া পর্যন্ত এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা উচিৎ। ডব্লিএইচও বলছে, সুস্থ হওয়ার পর ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত যৌন সম্পর্কের সময় সতর্কতা হিসেবে কনডম ব্যবহার করা উচিৎ।

সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি।

এসএস