বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে একটি পোশাক কারখানা। গত বছরের ছবি

কিছুদিন আগেও বাংলাদেশকে ‘ইকোনমিক মিরাকল’ বলে অভিহিত করা হতো। টেক্সটাইল এবং পোশাক রপ্তানির দিকে দেশটির একক মনোযোগ অর্থনীতিতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি এনে দিয়েছিল।

আর এটি লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে এবং এতে করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বেশ খ্যাতি ও প্রশংসা পেয়েছিলেন।

কিন্তু গত সপ্তাহে ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভে ক্ষমতা থেকে হাসিনার আকস্মিক প্রস্থান সেই কৌশলটির সীমাবদ্ধতাকে সবার সামনে উন্মোচিত করেছে। মূলত বাংলাদেশ প্রচণ্ড মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্বের সাথে লড়াই করছে এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন— এটি মূলত দুর্বল নীতিগত সিদ্ধান্তেরই ফলাফল। হাসিনার ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং বাংলাদেশের ব্যাপক দুর্নীতি কেবল দেশের মানুষের হতাশাই বাড়িয়েছে এবং এটিই শেষপর্যন্ত তাকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদে বাধ্য করেছে।

এখন বাংলাদেশকে তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে।

যে ছাত্র বিক্ষোভকারীরা হাসিনার পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিল তারা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে এসেছে। ড. ইউনূস এখন একটি কঠিন কাজের মুখোমুখি হয়েছেন।

অবিলম্বে বাংলাদেশকে অবশ্যই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে, বাংলাদেশকে সেই ব্যাপক অর্থনৈতিক চাপের মোকাবিলাও করতে হবে যা প্রতিবাদকারীদের প্রথমে রাস্তায় নামতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন বহাল থাকবে এবং কতটা ব্যাপক ম্যান্ডেট তারা গ্রহণ করবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু কানাডার বালসিলি স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স’র ফেলো সাদ হাম্মাদি বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার এবং ড. ইউনূসের ওপর অনেকের আকাঙ্খা আছে যে— তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে ন্যায়বিচার প্রদান করবেন, কার্যকরী অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটাবেন এবং আইনের শাসন ও একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন।’

সাদ হাম্মাদি বলছেন, এই চ্যালেঞ্জগুলো একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য খুব বেশি দায়িত্ব হয়ে উঠতে পারে। মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন নেতাদের নির্বাচিত হওয়া করা নিশ্চিত করা। আর এর জন্য প্রশাসনজুড়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন হবে।

বাংলাদেশ ১৯৭০ এর দশক থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্য চলছিল এবং পোশাক শিল্প গত কয়েক দশক ধরে দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা হাসিনা সেই একক খাতে দেশের ফোকাসকে আরও সংকুচিত করেন এবং নতুন বিশ্ব বাজারে প্রসারিত করেছিলেন, যা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছিল।

বাংলাদেশে সস্তায় তৈরি পোশাকগুলো বিশ্বব্যাপী পোশাকের খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয়, বিশেষ করে জারা এবং এইচএন্ডএম-এর মতো ব্র্যান্ডগুলোর পোশাক। একই সময়ে, সেই চাহিদা লক্ষাধিক মানুষের, বিশেষ করে নারীদের জন্য জীবিকা সৃষ্টি করেছে এবং জীবনযাত্রার মানও পরিবর্তন করেছে।

হাসিনা দেশের অবকাঠামোর জন্য প্রচুর পরিমাণে ব্যয় করেছিলেন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আশ্বস্ত করেছিলেন, তারা তাদের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করতে পারে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বাংলাদেশের কনসালটেন্ট টমাস কিন বলেন, ‘তিনি স্থিতিশীলতার একটি স্তর এনেছিলেন, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ছিল আকর্ষণীয়। তবে শ্রমিক ধর্মঘট, বিদ্যুৎ বিপর্যয় বা অন্যান্য কিছু কারণ যদি দেশটিকে অবিশ্বস্ত করে তোলে, তাহলে গার্মেন্টস ক্রেতারা বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা পাঠাতে পারবেন না।’

হাসিনা দেশের নিরাপত্তা বাহিনী এবং বিচার বিভাগকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া ভিন্নমতকে দমন করার পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদীও হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন উল্লেখ করে টমাস কিন বলেন, ‘দেশে এমন একটা বিশ্বাস ছিল— হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ হয়তো এমন একটি দল যারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন করবে।’

শেখ হাসিনার অধীনে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল। আর গত কয়েক বছরে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে। দেশের মোট আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি এসেছে পোশাক রপ্তানি থেকে।

কিন্তু সেই নির্ভরতাও ছিল হাসিনার সর্বনাশের কারণ।

কোভিড মহামারিতে টেক্সটাইল এবং পোশাকের বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। একই সময়ে, সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ আমদানিকৃত খাদ্য ও জ্বালানির দামও তীব্রভাবে বাড়িয়েছে। অর্থনীতিতে খুবই কম বৈচিত্র্যের কারণে, বিল পরিশোধে সহায়তা পেতে অন্যান্য শিল্প থেকে পর্যাপ্ত রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারেনি বাংলাদেশ।

ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে তা নিয়ন্ত্রণে হাসিনা সরকারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। দুর্বল হয়ে পড়া মুদ্রার মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করার সময় বাংলাদেশ তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমিয়ে দিয়েছে, আর এতে করে সেই রিজার্ভ এতটাই নিচে নেমে গেছে যে ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ঋণ চাইতে বাধ্য হয়েছিল হাসিনার সরকার।

মহামারির পরে যখন পোশাক রপ্তানি ফের চালু হতে শুরু করে তখন বাংলাদেশ আরও বেশ কিছু স্বল্পমেয়াদী সমস্যায় নিমজ্জিত ছিল। এটি ছিল এমন একটি পরিস্থিতি যা দেশের অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলোকেও সবার সামনে তুলে ধরেছিল। আংশিকভাবে শিথিল আমলাতন্ত্র এবং অনেক নাগরিকের তাদের কর দিতে অনাগ্রহের কারণে বাংলাদেশ কর খুব কম সংগ্রহ করে থাকে। বাংলাদেশে ট্যাক্স থেকে জিডিপির অনুপাত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন অনুপাতের একটি। এর অর্থ হচ্ছে— বিল পরিশোধ করতে নিজেদের ট্যাক্স রাজস্বের ওপর নির্ভর করতে পারে না বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে এখনও উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার রয়েছে, কিন্তু অর্থনীতিবিদ এবং অন্যরা বলছেন, এই প্রবৃদ্ধি অসম এবং এতে আয় বৈষম্য অনেকে বেশি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখার জামান বলেছেন, কাগজে-কলমে প্রবৃদ্ধির গল্পটি বাস্তবতার সাথে মেলেনি। আরিএর ফলে সরকারের প্রতি মানুষের অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে।

ইফতেখার জামান বলেন, ঋণ জালিয়াতি এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অনেকের অর্থ পাচারের রিপোর্টসহ নির্লজ্জ দুর্নীতি মানুষের মাঝে আরও অসন্তোষের বীজ বপন করেছে। তিনি বলেন, ‘সবাই জানত, যাদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার কথা, তাদের দ্বারাই দুর্নীতি জিইয়ে রাখা হচ্ছে।’

এছাড়া হাসিনার জন্য সবচেয়ে বড় দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা ছিল গার্মেন্টস ব্যবসার প্রতি অতি মনোযোগের কারণে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তার সরকারের ব্যাপক অক্ষমতা। দেশের বৃহৎ কর্মজীবী ​​জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত নতুন বা ভালো বেতনের চাকরি নেই।

গত মাসে সেই ক্রমবর্ধমান হতাশা প্রকাশের একটি সুযোগ খুঁজে পায় সাধারণ মানুষ যখন শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকারমূলক কোটা পদ্ধতির অবসানের দাবি করতে শুরু করেন। ক্রমেই এই আন্দোলন ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভে পরিণত হয় এবং হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

এরপর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। নতুন সরকারের এই প্রধান দেশের সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো পাশাপাশি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতা পরিহার করার জন্য জাতির কাছে আবেদন জানান।

যদিও এটা স্পষ্ট নয় তিনি ঠিক কতদিন এই পদে থাকবেন, তবে ড. ইউনূস বাজার-বান্ধব বিভিন্ন সংস্কার কাজ পরিচালনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

টিএম