বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘‘জীবন রক্ষা করায়’’ নয়াদিল্লিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। একই সঙ্গে দেশে ‘‘উচ্ছৃঙ্খল শাসন’’ চালু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। পাশাপাশি দ্রুত নির্বাচন না হলে সামনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি।

রোববার ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন শেখ হাসিনার সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা ও ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মুখে গত সোমবার (৫ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা এবং হেলিকপ্টারে করে দীর্ঘদিনের মিত্র ভারতে পালিয়ে যান।

শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের মেয়াদে হাজার হাজার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত সোমবার সামরিক বাহিনী শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘোষণা দেয়। ওইদিন ছাত্রদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নিতে রাজি হন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস (৮৪)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত শেখ হাসিনার ছেলে ও সাবেক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় (৫৩) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‌‌‘‘পুরোপুরি ক্ষমতাহীন’’ বলে সমালোচনা করেছেন।

ওয়াশিংটন থেকে এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জয় বলেছেন, ‘‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশে উচ্ছৃঙ্খল শাসন চলছে।’’ তিনি বিক্ষোভকারীদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং পুলিশ প্রধানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দিকে ইঙ্গিত করে এই মন্তব্য করেন।

জয় বলেন, আগামীকাল যদি জনতা বলে, না আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকা এই ব্যক্তিকে পরিবর্তন করতে চাই, তাহলে তাদের পরিবর্তন করতে হবে।

• বিশৃঙ্খলায় পতিত

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তিনি কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচন চান। সজীব ওয়াজেদ জয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেরী হলে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটা নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের সর্বোত্তম স্বার্থের বিষয়... নির্বাচনের মাধ্যমে এমন একটি বৈধ সরকারে ফিরে আসতে হবে, যেখানে জনগণের ন্যায্য অধিকার ও সত্যিকারের কর্তৃত্ব থাকবে।

‘‘অন্যথায়, তারা কেবল বিশৃঙ্খলায় পতিত হতে চলেছে।’’

শেখ হাসিনা গত জানুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভ করেন। যদিও ওই নির্বাচন অবাধ কিংবা সুষ্ঠু হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দেশের প্রকৃত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো ওই নির্বাচন বয়কট করে। সেই সময় দমন-পীড়নের পাশাপাশি বিরোধী দলীয় হাজার হাজার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সদস্যরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা ও পার্টি অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সজীব ওয়াজেদ বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য দলটি গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, আমাদের লাখ লাখ অনুসারী আছেন; তারা কোথাও যাচ্ছেন না।  ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া আপনারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। এটা দেশের অর্ধেক মানুষ কখনই মেনে নেবে না।

সাবেক বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বছরের পর বছর ধরে দমন-পীড়নের শিকার হওয়ার পরও পুনর্গঠিত হয়েছে। সোমবারের পর থেকে ঢাকায় শান্তিপূর্ণ গণসমাবেশ করছে বিএনপি।

সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে করতে হবে। আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে।’’

• অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ

সজীব ওয়াজেদ জয় তার মায়ের ক্ষমতাচ্যুতির জন্য সরকারে থাকা অন্যদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘সেখানে কোনও ভুল করা হয়েছিল? অবশ্যই ভুল করা হয়েছিল। এসব ভুল নিচের লোকজন বা চেইন অব কমান্ডে হয়েছিল... এই ভুলের জন্য আমার মাকে দোষ দেওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক।’’

বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো পুলিশ কর্মকর্তারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছেন বলে স্বীকার করলেও জয় বলেছেন, উভয়পক্ষের সহিংসতা ছিল। তিনি বলেন, কিছু পুলিশ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। কিন্তু পুলিশের ওপরও হামলা হয়েছে। পুলিশ সদস্যরাও নিহত হয়েছেন। সহিংসতা একপাক্ষিক ছিল না। 

‘‘তারপর উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিক্ষোভকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র, অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালাতে শুরু করে।’’

শেখ হাসিনার পতনের আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ৪৫০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। যাদের মধ্যে ৪২ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন বলে পুলিশ প্রধান জানিয়েছেন। অজ্ঞাত বিদেশি শক্তি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে সমর্থন দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন জয়। যদিও এই অভিযোগের কোনও প্রমাণ দিতে পারেননি তিনি।

জয় বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে আমি বিশ্বাস করি এটা বাংলাদেশের বাইরে থেকে করা হয়েছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘কেবল একটি গোয়েন্দা সংস্থাই বিক্ষোভকারীদের কাছে অস্ত্র পাচার ও সরবরাহ করার ক্ষমতা রাখে।’’

তবে শেখ হাসিনা এরপর কী করবেন তা স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছে এএফপি। শেখ হাসিনার জীবন রক্ষা ও তাকে নিরাপদ নিরাপদ রাখার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সজীব ওয়াজেদ জয়।

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি গোপন সেইফ হাউজে রেখেছে নয়াদিল্লি। নয়াদিল্লির কাছের হিন্দন বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কথা বলেননি তিনি। তবে তিনি কতদিন ভারতে থাকবেন সেটি পরিষ্কার নয়। সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, আপাতত তৃতীয় কোনও দেশে তার মায়ের যাওয়ার পরিকল্পনা নেই।

জয় বলেন, আমার মা কখনই দেশ ছেড়ে যেতে চাননি। দেশেই অবসর নেওয়ার স্বপ্ন তার। প্রত্যেক দিন মায়ের সঙ্গে কথা বলেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

‘‘এটাই তার শেষ মেয়াদ ছিল। তার বয়স ৭৬ বছর। আর তাই তিনি কেবল বাড়িতে ফিরে যেতে চান। তিনি পারবেন কি না, আমরা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি।’’

এসএস