ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হয়েছেন। ইরানের রাজধানী তেহরানে আবাসস্থলে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। হামলায় হানিয়ার এক দেহরক্ষীও নিহত হয়েছেন।

হানিয়ার আকস্মিক এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে তার অবর্তমানে হামা‌সের হাল ধর‌বেন কে? ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জন্মলগ্ন থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া স্বাধীনতাকামী এই গোষ্ঠীটির সবচেয়ে বিশিষ্ট নেতাই বা কারা?

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তাদের নিজেদের সম্পর্কে খুব কম তথ্যেই সামনে আনেন, অন্যদের অনেকেই আবার ইসরায়েলের হত্যা প্রচেষ্টা এড়াতে তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন। এখানে হামাসের সবচেয়ে বড় কয়েকজন নেতার কথা তুলে ধরা হলো।

ইসমাইল হানিয়া

ইরানে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তেহরানে গিয়েছিলেন তিনি।

আর সেখানেই নিজের আবাসস্থলে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। হামলায় হানিয়ার এক দেহরক্ষীও নিহত হয়েছেন। ইরানে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ইসমাইল হানিয়াকে ব্যাপকভাবে হামাসের সামগ্রিক নেতা হিসাবে বিবেচনা করা হতো।

তিনি হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ সরকারের দশম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইসরায়েল ১৯৮৯ সালে তাকে তিন বছর বন্দি করে রাখে। এরপর তাকে মারজ আল-জুহুর নামের ইসরায়েল এবং লেবাননের মধ্যকার একটি নো-ম্যানস-ল্যান্ডে নির্বাসিত করা হয়।

সেখানে তিনি ১৯৯২ সালে বেশ কয়েকজন হামাস নেতার সাথে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে একটি পুরো বছর কাটিয়েছিলেন। নির্বাসনে থাকার পর তিনি গাজায় ফিরে আসেন এবং ১৯৯৭ সালে হামাস আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের অফিসের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন, যা তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে।

২০০৬ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীর এবং গাজায় সংসদীয় নির্বাচন আয়োজন করে এবং সেসময় হানিয়া হামাসের সংসদীয় নেতা ছিলেন। ইসলামপন্থি এই গোষ্ঠী নির্বাচনে আশ্চর্যজনক বিজয় অর্জন করে এবং হানিয়া ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী’ হন।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের দল ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলে আব্বাস ২০০৭ সালে হামাস সরকার ভেঙে দেন। হানিয়া তার সেই বিতর্কিত ডিক্রি মেনে নেননি এবং গাজা থেকে তার শাসন চালিয়ে যান। অন্যদিকে ফাতাহ ফিলিস্তিনের আরেক অংশ পশ্চিম তীরে কর্তৃত্ব বজায় রাখে।

মূলত হানিয়া সেসময় তার বরখাস্তকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেসময় তিনি জোর দিয়ে বলেন, তার সরকার ‘ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের যে জাতীয় দায়িত্ব রয়েছে তা পরিত্যাগ করবে না’, এবং গাজায় হামাস তার শাসন অব্যাহত রাখে।

২০১৭ সালে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৮ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর হানিয়াকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে মনোনীত করে। তিনি গত কয়েক বছর ধরে কাতারে বসবাস করে আসছিলেন।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার

গাজা উপত্যকার হামাস আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাজদ নামে পরিচিত হামাসের নিরাপত্তা পরিষেবার প্রতিষ্ঠাতা। এটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো পরিচালনা করে থাকে।

একইসঙ্গে এই সংস্থাটি সন্দেহভাজন ইসরায়েলি এজেন্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে এবং ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা পরিষেবার কর্মকর্তাদের সন্ধান করে থাকে।

এখন পর্যন্ত তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছেন সিনওয়ার। ১৯৮৮ সালে তৃতীয়বার গ্রেপ্তারের পর হামাসের এই নেতাকে চারটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে হামাস-ইসরায়েল বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে তিনি মুক্তি পান এবং গাজায় ফিরে আসেন।

মুক্তির পর সিনওয়ার হামাসের বিশিষ্ট নেতা হিসাবে তার আগের অবস্থানে ফিরে আসেন এবং ২০১৭ সালে গাজা উপত্যকায় স্বাধীনতাকামী এই গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নিযুক্ত হন। অবশ্য ২০১৫ সালে সিনওয়ারকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের’ কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

ইসমাইল হানিয়াহের উত্তরসূরি হিসেবে ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী সিনওয়ার গাজা উপত্যকার রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন।

মোহাম্মদ দেইফ

মোহাম্মদ দেইফ হামাস আন্দোলনের সামরিক শাখা ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডের নেতৃত্ব রয়েছেন। তিনি এমন একজন ছায়াময় ব্যক্তিত্ব যিনি ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘দ্য মাস্টারমাইন্ড’ এবং ইসরায়েলিদের কাছে ‘দ্য ক্যাট উইথ নাইন লাইভস’ নামে পরিচিত।

বিবিসি বলছে, মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে এবং ইসরায়েলিদের কাছে ‘মৃত্যুর মানুষ’ বা ‘নয়টি জীবন নিয়ে জন্মানো যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত। ইসরায়েলের ফেরারী সন্ত্রাসী তালিকায় তার নাম সবার ওপরে।

মীলত মোহাম্মদ দেইফ হচ্ছেন হামাসের সামরিক শাখার কমান্ডার। দেইফকে হত্যার জন্য ইসরায়েল হন্যে হয়ে খুঁজছে। বছরের পর বছর ধরে বহু চেষ্টা চালিয়েও তাকে কোনোভাবেই ধরতে পারছে না ইসরায়েল।

২০২১ সালে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে লড়াই চলাকালে মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার চেষ্টা করেছিল ইসরায়েল, কিন্তু তাকে হত্যা করা যায়নি। তখন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র হিডাই যিলবারম্যান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ‘এই পুরো অভিযান চলার সময় আমরা মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার চেষ্টা করেছি।’

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা ২০২১ সালে বিবিসির কাছে নিশ্চিত করেছিলেন, মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার জন্য অন্তত দুটি চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু সেবারও ইসরায়েলিদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, মোহাম্মদ দেইফ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বলা হচ্ছে, গত দুই দশকে ইসরায়েল মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার জন্য সাতবার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে।

মোহাম্মদ দেইফকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা এই ইঁদুর-বেড়াল খেলা নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীও বেশ হতাশ। ২০২১ সালে লড়াইয়ের সময়েও তাদের লক্ষ্য ছিল হামাসের সব শীর্ষ সামরিক অধিনায়ককে হত্যা করা।

মোহাম্মদ দেইফ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি অভিনয় এবং থিয়েটার প্রতি আগ্রহের জন্য পরিচিত ছিলেন, আর সেখানে তিনি একটি শিল্পী দলও গঠন করেছিলেন।

যখন হামাসের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়, তিনি বিনা দ্বিধায় এই দলে যোগ দেন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯৮৯ সালে গ্রেপ্তার করে, আর হামাসের সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করার অভিযোগে বিনা বিচারে ১৬ মাস কারাগারে কাটান তিনি।

মোহাম্মদ দেইফ সম্পর্কে যা জানা যায়, তা মূলত ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে। এসব রিপোর্ট অনুসারে, মোহাম্মদ দেইফের জন্ম ১৯৬গ এর দশকে গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে। গাজা তখন ছিল মিসরের দখলে।

জন্মের সময় তার নাম রাখা হয়েছিল মোহাম্মদ ডিয়াব ইব্রাহীম আল-মাসরি। কিন্তু ইসরায়েলি বিমান হামলা হতে বাঁচতে তাকে যেভাবে সারাক্ষণ যাযাবরের মতো জীবন-যাপন করতে হয়, পরে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন ‘দেইফ’ নামে, আরবিতে যার অর্থ ‘অতিথি’।

বহু দশক ধরে চলতে থাকা ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের মধ্যে কীভাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সে সম্পর্কেও জানা যায় খুব কম। হামাস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মোহাম্মদ দেইফ একজন তরুণ। ১৯৮০-এর দশকের শেষে তিনি হামাসে যোগ দেন।

হামাসের সামরিক শাখা ‘আল-কাসাম ব্রিগেড’ গঠনের পর মোহাম্মদ দেইফ বেশ দ্রুত ওপরের দিকে উঠতে থাকেন, তিনি বেশ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি এমন টানেল নির্মাণে প্রকৌশলীকে সাহায্য করেছিলেন যা হামাস যোদ্ধাদের গাজা থেকে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সুযোগ এনে দেয়।

মূলত দেইফ গাজা থেকে হামাস যোদ্ধাদের ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য নির্মিত টানেলের প্রকৌশলী ছিলেন এবং একইসঙ্গে বড় সংখ্যক রকেট উৎক্ষেপণের কৌশল গ্রহীতাদের একজন ছিলেন তিনি।

এখন পর্যন্ত দেইফের কেবল তিনটি ছবি রয়েছে: একটি খুব পুরোনো, দ্বিতীয়টি মুখোশ পরা এবং তৃতীয়টি তার ছায়ার ছবি।

হামাসের যে বিখ্যাত ‘কাসাম রকেট’, সেটির পরিকল্পনা এবং তৈরির কৃতিত্ব দেওয়া হয় মোহাম্মদ দেইফকে। গাজার ভূগর্ভে যেসব টানেল খনন করা হয়েছে, সেগুলোও মোহাম্মদ দেইফের পরিকল্পনা। তিনি নাকি বেশিরভাগ সময় এসব টানেলের মধ্যে কাটান। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চোখ এড়িয়ে এখান থেকেই তিনি হামাসের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

দেইফকে হত্যা করার সবচেয়ে জোরালো প্রচেষ্টা হয়েছিল ২০০২ সালে, যেটা থেকে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও নিজের একটি চোখ হারান তিনি। ইসরায়েলের তথ্যমতে, তিনি তার একটি পা এবং একটি হাতও হারিয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকবার হত্যা প্রচেষ্টার পর বেঁচে থাকলেও তার কথা বলতে অসুবিধা হয়।

এর মধ্যে কয়েকটি হামলায় তিনি আহত হলেও পালাতে সক্ষম হন। ইসরায়েলি রিপোর্ট অনুযায়ী, তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, শরীরের কয়েকটি অঙ্গ উড়ে গেছে। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি আবারও সেরে উঠেন।

ইসরায়েলের এসব হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর মোহাম্মদ দেইফের খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। তাকে তার শত্রুপক্ষ ‘৯টি জীবন জন্মানো যোদ্ধা’ বলে বর্ণনা করে থাকে।

মারওয়ান ইসা

‘ছায়া মানুষ’ এবং মোহাম্মদ দেইফের ডান হাত নামে পরিচিত মারওয়ান ইসা ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডসের ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ এবং হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যুরোর সদস্য।

খুব কম বয়সে হামাসের কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘প্রথম ইন্তিফাদা’ চলাকালীন ইসরায়েলি বাহিনী তাকে আটক করে এবং এরপর পাঁচ বছর বন্দি রেখেছিল।

ইসরায়েল বলছে, যতদিন তিনি জীবিত থাকবেন, হামাসের সাথে তার ‘মস্তিষ্কের যুদ্ধ’ অব্যাহত থাকবে। তারা তাকে ‘কথা নয়, কাজের লোক’ হিসাবে বর্ণনা করে এবং বলে, তিনি এতটাই চালাক যে কোন ‘প্লাস্টিককেও ধাতুতে পরিণত করতে পারেন’ তিনি।

মারওয়ান ইসা একজন বিশিষ্ট বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি পেলেও ক্রীড়া তার পেশা ছিল না, কারণ ১৯৮৭ সালে হামাস আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অভিযোগে ইসরায়েল তাকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেপ্তার করে এবং ২০০০ সালের ‘আল-আকসা ইন্তিফাদার’ আগ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইসা আল-কাসসাম ব্রিগেডসের সামরিক ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে তিনি ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় জায়গা করে নেন। ২০০৬ সালে দেইফ এবং আল-কাসাম ব্রিগেডসের প্রধান নেতাদের সঙ্গে সাধারণ কর্মীদের একটি বৈঠকের সময় ইসরায়েলিরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তিনি আহত হলেও ইসরায়েলের তাকে নির্মূল করার লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

২০১৪ এবং ২০২১ সালে গাজা আক্রমণের সময় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো তার বাড়িও দুবার ধ্বংস করেছি। সেই আক্রমণে তার ভাই মারা যায়। ২০১১ সালে ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতের বিনিময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের অভ্যর্থনা করার সময় তোলা একটি গ্রুপ ছবির আগে তার চেহারা কারো জানা ছিল না।

নম-দে-গুয়েরে আবু আল-বারা নামেও পরিচিত ইসা ২০১২ সালের ‘শেল স্টোনস’ থেকে ২০২৩ সালের হামলা পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধের পরিকল্পনায় তার ভূমিকা স্পষ্ট। এতে মাঠপর্যায়ের শক্তি, গোয়েন্দা ও প্রযুক্তি বাহিনী, সংগঠিত ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার পরিধি এবং বসতি ও নিরাপত্তা সদর দপ্তরের ওপর বিশেষ নজর দেওয়া- সবকিছুই তার জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়।

খালেদ মেশাল

খালেদ মেশাল ‘আবু আল-ওয়ালিদ’ ১৯৫৬ সালে সিলওয়াদের পশ্চিম তীরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারসহ কুয়েতে চলে যাওয়ার আগে তিনি সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। আর কুয়েতে যাওয়ার পর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন।

মেশাল হামাস আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য। ১৯৯৬ এবং ২০১৭ সালের মধ্যে তিনি রাজনৈতিক ব্যুরোর সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৪ সালে শেখ আহমেদ ইয়াসিনের মৃত্যুর পর এর নেতা নিযুক্ত হন।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ১৯৯৭ সালে মেশালকে হত্যার জন্য গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের প্রধানকে নির্দেশ দেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে বলেছিলেন।

মোসাদের দশজন এজেন্ট কানাডার জাল পাসপোর্ট নিয়ে জর্ডানে প্রবেশ করে সেই সময়ে জর্ডানের নাগরিক খালেদ মেশালকে রাজধানী আম্মানের একটি রাস্তায় হাঁটার সময় বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে ইনজেকশন দেওয়া হয়।

জর্ডানের কর্তৃপক্ষ হত্যা প্রচেষ্টার সন্ধান পায় এবং জড়িত দুই মোসাদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। জর্ডানের প্রয়াত বাদশাহ হুসেইন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কাছে মেশালকে যে বিষাক্ত পদার্থের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল তার প্রতিষেধক চান, কিন্তু নেতানিয়াহু প্রথমে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হস্তক্ষেপে নেতানিয়াহুকে প্রতিষেধক সরবরাহ করতে বাধ্য করায় এই হত্যা প্রচেষ্টা একটি রাজনৈতিক মাত্রা নেয়।

মেশাল ২০১২ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো গাজা উপত্যকায় যান। ১১ বছর বয়সে তিনি চলে যাওয়ার পর ফিলিস্তিনি অঞ্চলে এটাই তার প্রথম সফর ছিল। রাফাহ ক্রসিংয়ে পৌঁছানোর পর বিভিন্ন দল ও জাতীয় পর্যায়ের ফিলিস্তিনি নেতারা তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং গাজা শহরে পৌঁছনো পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে রাস্তার ধারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল।

২০১৭ সালের ৬ মে আন্দোলনের শুরা কাউন্সিল ইসমাইল হানিয়াকে রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান হিসাবে নির্বাচিত করে।

মাহমুদ জাহার

মাহমুদ জাহার ১৯৪৫ সালে গাজার একজন ফিলিস্তিনি বাবা এবং একজন মিসরীয় মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এবং মিসরের ইসমাইলিয়া শহরে তার শৈশব কাটান। গাজাতেই তিনি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন।

এরপর ১৯৭১ সালে কায়রোর আইন শামস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি জেনারেল মেডিসিনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৭৬ সালে জেনারেল সার্জারিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকের পর তার রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত তিনি গাজা এবং খান ইউনিসের হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন।

জাহারকে হামাসের অন্যতম প্রধান নেতা এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হামাস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার ছয় মাস পর ১৯৮৮ সালে মাহমুদ জাহারকে ছয় মাস ইসরায়েলি কারাগারে রাখা হয়েছিল।

১৯৯২ সালে ইসরায়েল থেকে মারজ আল-জুহুরে নির্বাসিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিও ছিলেন, যেখানে তিনি পুরো এক বছর কাটিয়েছেন।

২০০৫ সালে হামাস আন্দোলন আইনসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর থেকে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিন সরকারকে বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়ার সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন জাহার।

ইসরায়েল ২০০৩ সালে গাজা শহরের রিমাল এলাকায় জাহারের বাড়িতে এফ-১৬ বিমান থেকে অর্ধটন ওজনের একটি বোমা ফেলে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। হামলায় তিনি সামান্য আহত হলেও তার বড় ছেলে খালেদের মৃত্যু হয়।

২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি গাজার পূর্বে ইসরায়েলি অভিযানে নিহত ১৮ জনের একজন ছিলেন তার দ্বিতীয় ছেলে হোসাম। হোসাম কাসাম ব্রিগেডের সদস্যও ছিলেন।

টিএম