ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও রাজধানী পূর্ব জেরুজালেম অঞ্চলে ক্ষমতাসীন ফাতাহের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাস। মঙ্গলবার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে হামাসের মুখপাত্র ও জেষ্ঠ্য নেতা মুসা আবু মারজুক এবং ফাতাহের মুখপাত্র মাহমুদ আল আলাওলের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।

চুক্তি স্বাক্ষরের পর বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মুসা আবু মারজুক। সংবাদ সম্মেলনে হামাসের এই জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, “আজ আমরা জাতীয় ঐক্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছি এবং এই চুক্তিকে আমরা আরও অগ্রসর করতে চাই। আমরা, স্বাক্ষরকারী সবপক্ষ এই চুক্তির শর্তগুলো মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১২টি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা চুক্তি স্বাক্ষর ও তার পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।  

সংবাদ সম্মেলনে ওয়াং ই বলেন, “এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো— হামাস, ফাতাহ এবং স্বাক্ষরকারী অন্যান্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর নেতারা যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে একটি ঐক্যবদ্ধ জোট সরকার গঠনে একমত হয়েছেন।”

“পুরোনো দ্বন্দ্ব ভুলে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া অবশ্যই তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার; তবে একই সঙ্গে এ ও সত্য যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ও সমর্থন ব্যতীত এই ঐক্য অর্জন সম্ভব নয়,” বলেন ওয়াং।

গাজা, পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম— তিন ভূখণ্ডের সমন্বয়ে গঠিত ফিলিস্তিন। ২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করছে সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামাস। অন্যদিকে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ক্ষমতায় রয়েছে রাজনৈতিক দল ফাতাহের নেতৃত্বাধীন জোট ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (প্যালেস্টাইনিয়ান অথরিটি-পিএ)। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ফাতাহের শীর্ষ নেতা।

এক সময় গাজা উপত্যকায়ও ক্ষমতায় ছিল ফাতাহ। কিন্তু ২০০৭ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে গাজার ক্ষমতা গ্রহণের পাশাপাশি ফাতাহকে উপত্যকা থেকে উচ্ছেদ করে হামাস।

দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধিতার প্রধান ইস্যু স্বাধীনতা অর্জনের পন্থা নিয়ে। ফাতাহ সংলাপ এবং রাজনৈতিক তৎপরতার ভিত্তিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে। অন্যদিকে হামাস বিশ্বাস করে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমেই কেবল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন সম্ভব।

ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে ফাতাহের চেয়ে হামাসের জনপ্রিয়তা বেশি, তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গাজা নিয়ন্ত্রণকারী এই গোষ্ঠীটির তেমন কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে বেশ কয়েক বছর আগেই। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলো হামাসকে এখনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে ঘোষণা না করেনি; তবে অধিকাংশ দেশ সব সময় এই গোষ্ঠীটির সংশ্রব থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনের পথে বড় যে কয়েকটি বাধা রয়েছে, হামাসের সঙ্গে ফাতাহ এবং গণতান্ত্রিক অন্যান্য গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব সেসবের মধ্যে একটি। গত এপ্রিলের শেষ দিকে হামাস এবং ফাতাহর পুনর্মিলনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে চীনের। তার তিন মাসের মাথায় ঐক্যচুক্তি হলো দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে এক মঞ্চে নিয়ে আসা প্রায় অসাধ্য একটি কাজ ছিল।

অবশ্য গাজার বর্তমান পরিস্থিতি হামাস ও ফাতাহকে একমঞ্চে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করছেন অনেক রাজনীতি বিশ্লেষক। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালায় হামাস যোদ্ধারা। তাদের হামলায় নিহত হন অন্তত ১ হাজার ২০০ জন ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য দেশের নাগরিক। এছাড়া ২৪০ জনকে জিম্মি হিসেবে গাজায় ধরে নিয়ে যায় হামাস যোদ্ধারা। এই জিম্মিদের মধ্যে ১১৬ এখনও মুক্তি পাননি।

ভয়াবহ সেই হামলার জবাবে ৭ অক্টোবর থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসলায়েলি সেনারা। তাদের সেই অভিযান এখনও চলছে এবং গত ৯ মাসে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় নিহত হয়েছেন ৩৯ হাজারেরও বেশি মানুষ। পুরো গাজা উপত্যকা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।

সূত্র : এএফপি

এসএমডব্লিউ