যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের মনোনয়নের পথ একটু একটু করে প্রশস্ত হচ্ছে। গত রোববার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনি লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

এর পরিবর্তে তার উত্তরসূরি হওয়ার জন্য তিনি নাম প্রস্তাব করেছেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের। ডেমোক্র্যাটদের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতার সমর্থন পেলেও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াইতে মনোনীত হননি হ্যারিস।

এখন তার দলের কাছ থেকে এই মনোনয়ন অর্জন করার বিষয়টা যদি সহজ হয়েও যায়, তাহলেও কমলা হ্যারিসের সামনে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ এখনও আসা বাকি। আর এই চ্যালেঞ্জ হলো- নভেম্বরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করা।

সাম্প্রতিক জনমত জরিপ বলছে, কমালা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছেন। ঠিক যে অবস্থানে জো বাইডেন নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেওয়ার মতো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার করার আগে।

তবে চিত্রটা বদলাতে পারে যদি আমরা দুই প্রার্থীর মধ্যে এই তুলনাকে অনুমিত অবস্থা থেকে বাস্তবের ময়দানে নিয়ে যাই।

এই বিষয়টা ঠিক যে, গত তিন সপ্তাহ ধরে প্রার্থী হিসাবে বাইডেনের ফিটনেস, নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, এবং তাকে নিয়ে ওঠা অন্যান্য প্রশ্নকে সামাল দিতে গিয়ে দলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তারপর এই নতুন অবস্থান (কমলা হ্যারিসের নাম প্রস্তাব) ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে নতুন শক্তি জুগিয়েছে।

দলের শীর্ষস্থানীয় সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের সকলেই প্রায় মনোনয়নের বিষয়ে হ্যারিসের প্রতি সমর্থন দেখিয়েছেন। হাউসের সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, যাকে ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসাবে মনে করা হয়, তিনিও এই তালিকায় রয়েছেন।

নভেম্বর মাসের নির্বাচনে একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা যাবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের কাছে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ হলো- ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি ‘বিদ্বেষ’কে ‘পুঁজি’ হিসাবে ব্যবহার করা, প্রধান সুইং স্টেটগুলোতে মধ্যপন্থি ভোটারদের আকৃষ্ট করা এবং ডেমোক্র্যাটিক বেসকে শক্তিশালী করে তোলা।

প্রসঙ্গত, ‘সুইং স্টেট’ বা ‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেট’ হলো এমন কয়েকটা মার্কিন অঙ্গরাজ্য, যেগুলো প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আবার নতুন ভাবে শুরু?

ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে এই ‘রিসেট’ বা ‘পুন:স্থাপন’-এর বিষয়টা আসে একটা ‘ডলারের’ চিহ্নকে সঙ্গে করে। কমলা হ্যারিসের প্রচার শিবিরের তথ্য অনুযায়ী, জো বাইডেনের প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভাইস প্রেসিডেন্ট নতুন অনুদান হিসেবে ৮ কোটি ডলারের বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছেন, যা এবারের নির্বাচনে কোনও প্রার্থীর একদিনে সংগ্রহ করা অনুদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

এর পাশাপাশি, বাইডেন-হ্যারিসের তহবিল থেকে ‘উত্তরাধিকার সূত্রে’ পাওয়া প্রায় ১০ কোটি ডলার হ্যারিসকে তার আসন্ন নির্বাচনি প্রচারের জন্য একটা মজবুত আর্থিক ভিত্তি দিয়েছে।

সম্ভাব্য ইতিবাচক দিক

এখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট যদি আনুষ্ঠানিকভাবে তার দলের মনোনয়ন পান, তাহলে এই নির্বাচনে রিপাবলিকানরা তাদের প্রতিপক্ষ ‘ডেমোক্র্যাটদের’ বিরুদ্ধে যে সবচেয়ে কার্যকর আক্রমণ চালিয়ে এসেছিল তার একটা মোক্ষম উত্তরও দিতে পারবেন। এবং সেটা হলো – প্রার্থীর বয়স।

গত কয়েক মাস ধরে, ট্রাম্প তার প্রচারের সময় তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন ‘দুর্বল’ এবং ‘সহজেই বিভ্রান্ত’ হয়ে পড়েন এমন অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে তীব্র কটাক্ষ করেছিলেন। জুন মাসের শেষের দিকে একটি বিতর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘পারফরম্যান্স’-এর পর এই আক্রমণ আরও তীব্র হয়।

দলের অন্দরেও প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য ৮১ বছরের জো বাইডেনের উপর চাপ বাড়তে থাকে।

অন্যদিকে কমলা হ্যারিসের বয়স ৫৯। পূর্ণ উদ্যমী হয়ে তিনি প্রচারের ময়দানে নামবেন বলেই অনুমান করা যেতে পারে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প এতদিন যে বয়সের বিষয়কে সামনে রেখে বাইডেনকে আক্রমণ করে এসেছিলেন, তার একটা মোক্ষম জবাব দিতে পারবেন।

শুধু তাই নয়, এই বয়সের বিষয়টাকেই তিনি চাইলে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। কারণ জিতলে, ৭৮ বছরের এই রিপাবলিকান প্রার্থীই হবেন এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট।

কমলা হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের কাছ থেকে সমর্থন পেতে সক্ষম হতে পারেন, যারা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাইডেনের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন বলে জনমত জরিপে উঠে এসেছিল। তিনি যদি অন্যান্য সংখ্যালঘু এবং তরুণ ভোটারদের কাছ থেকে আরও সমর্থন পেতে পারেন - যা ২০০৮ এবং ২০১২ সালে বারাক ওবামার নির্বাচনি সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তাহলে তা আসন্ন ভোটে সুইং স্টেস্টগুলোতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শক্ত জমি পেতে হ্যারিসকে সাহায্য করতে পারে।

প্রসিকিউটর হিসাবে হ্যারিসের ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু তার প্রার্থীপদকে মজবুত করবে। তার ক্যারিয়ারের এই দিক অবশ্য ২০১৯ সালের ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের সময় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বামপন্থিদের কাছ থেকে আক্রমণের মুখেও ফেলেছিল তাকে।

অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বামপন্থিদের কাছ থেকে শুনতে হয়েছিল ‘কমলা একজন পুলিশ’। তবে এই নির্বাচনে সমীকরণটা বদলেছে। কর্মজীবনে তার এই আইনি ব্যাকগ্রাউন্ড তাকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রচারের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।

ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিস কিন্তু গর্ভপাতের সমর্থনে কথা বলেছেন যা সাম্প্রতিক নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটের পক্ষে ইতিবাচক বলে প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে, এই ইস্যুতে বাইডেনকে কখনও কখনও অনিচ্ছুক সমর্থক হিসবে দেখা গিয়েছে। এই প্রক্রিয়ার কিছু সীমাবদ্ধতা সমর্থন করতে দেখা গেছে।

নিউইয়র্কের সাবেক কংগ্রেসম্যান স্টিভ ইসরায়েল বিবিসির আমেরিকাস পডকাস্টকে বলেন, ‘আমি মনে করি তিনি (কমলা হ্যারিস) দেশজুড়ে শহরতলির (বিশেষত ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটে বসবাসকারী) নারীদের মনে করিয়ে দেন যে, প্রজনন বিষয়ক অধিকার কতটা ঝুঁকির মুখে রয়েছে। প্রচারাভিযানে একটা মৌলিক পুনর্বিন্যাস প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা।’

‘দুর্বলতা’

কমলা হ্যারিসের সমস্ত সম্ভাব্য শক্তি থাকা সত্ত্বেও ডেমোক্র্যাটরা প্রাথমিকভাবে বাইডেনকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে চাপ দিতে ইতস্তত করছিলেন। তার কারণ হলো- হিসেব মাফিক প্রেসিডেন্টের ‘রানিং মেট’-ই হবেন তার স্পষ্ট উত্তরসূরি।

গর্ভপাত ইস্যু নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে উৎসাহ তৈরি করলেও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসের রেকর্ড কিন্তু মিশ্র। বাইডেনের প্রশাসনের প্রথম দিকে, তাকে মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তে অভিবাসন সংকটের মূল কারণগুলোর মোকাবিলা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

এনবিসি নিউজের উপস্থাপক লেস্টার হল্টের সঙ্গে ২০২১ সালের জুনে একটি ‘হ্যাম-হ্যান্ড’ সাক্ষাৎকারসহ বেশ কয়েকটা ভুল পদক্ষেপ এবং ভুল বিবৃতি তার অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে তাকে রক্ষণশীলদের আক্রমণের মুখেও পড়তে হয়।

রিপাবলিকানরা ইতোমধ্যে কমলা হ্যারিসের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন এবং জনমত জরিপে উঠে আসা বাইডেন প্রশাসনের ‘জনপ্রিয় নয়’ এমন অভিবাসন নীতির জন্য তাকে দায়ী করছে। স্টিভ ইসরায়েল ব্যাখ্যা করেছেন, ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটগুলো’তে ডেমোক্র্যাটদের জন্য অভিবাসন একটা ‘দুর্বল জায়গা’।

তিনি বলছেন, ‘এই শহরতলিতে বসবাসকারী ভোটারদের জন্য এটা (অভিবাসন) খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা সে ন্যয্য হোক বা অন্যয্য। তারা মনে করে, আমাদের তরফে অভিবাসন সংক্রান্ত বিষয় খুব জোর দিয়ে মোকাবিলা করা হয়নি।’

ট্রাম্পের প্রচার শিবির ভাইস প্রেসিডেন্টের প্রসিকিউশনাল ব্যাকগ্রাউন্ডকে তারই বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। সাবেক প্রেসিডেন্টের ফৌজদারি বিচার সংক্রান্ত সংস্কার কার্যকর করার রেকর্ড তুলে ধরার পাশাপাশি ট্রাম্পের শিবির হ্যারিসের অতীতের প্রসিকিউটরিয়াল এবং প্যারোল সিদ্ধান্তকে ঘিরেও আক্রমণ করতে পারে।

এর আগে প্রার্থী হিসাবে তার ট্র্যাক রেকর্ড হ্যারিসের দুর্বলতা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও অনুমান করা হচ্ছে।

২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে দলের মধ্যে তার লড়াইও সফল হয়নি। ডেমোক্র্যাটিক মনোনয়নের প্রার্থী হিসাবে তিনি দ্রুত সিঁড়িতে উঠলেও তার ‘বিভ্রান্তিকর’ সাক্ষাৎকার, স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং দুর্বলভাবে পরিচালিত প্রচারের ফলে প্রাথমিক প্রতিযোগিতার আগেই বাদ চলে যেতে হয়েছিল কমালা হ্যারিসকে।

প্রথম ইমপ্রেশন

কমলা হ্যারিসের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মতো তিনি ক্ষমতাসীন নন। অনুমান করা যায়, রিপাবলিকানরা হ্যারিসকে ‘অপরীক্ষিত’ এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার পক্ষে ‘বেশ ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে তুলে ধরার চেষ্টা করবে।

উল্টোদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট নিজেকে ইতোমধ্যে পরীক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন। তবে, আগামী দিনে আমেরিকার জনগণের সামনে ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশন’ তৈরি করার সুযোগ রয়েছে হ্যারিসের সামনে।

কিন্তু তিনি যদি তিনি তার এই অভিযানের প্রথমেই হোঁচট খান, তাহলে সেটা আগস্ট মাসে ডেমোক্র্যাটদের জাতীয় কনভেনশন পর্যন্ত প্রসারিত একটা বর্ধিত ক্ষমতার লড়াইয়ের দরজা খুলে দেবে।

সে ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটরা অন্য কোনও প্রার্থীকে সম্মতিক্রমে বেছে নিতে পারে কিংবা তাদের মধ্যে অনৈক্য দেখা যেতে পারে। গত চার সপ্তাহ দেখিয়েছে, হোয়াইট হাউসের দৌড়ে ভাগ্যের পরিবর্তন কীভাবে দ্রুত হতে পারে।

হ্যারিস আমেরিকান রাজনীতির সবচেয়ে বড় মঞ্চে তার টিকিট ‘পাঞ্চ’ করেছেন। এখন তাকে দেখাতে হবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম। বিবিসি বাংলা

টিএম