যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (ফাইল ছবি)

টানা প্রায় ৯ মাস ধরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত চলছে। চলমান এই সংঘাতে সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

একইসঙ্গে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিষয়েও দেশটি নীরব। এই পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আরও একজন কর্মকর্তা। পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতির কঠোর সমালোচনাও করেছেন তিনি।

বুধবার (৩ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় প্রায় নয় মাস ধরে চলা যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিবাদে এখন পর্যন্ত অন্তত নয়জন মার্কিন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন।

পদত্যাগকৃত এসব কর্মকর্তাদের কেউ কেউ আবার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি নৃশংসতার বিষয়ে চোখ বন্ধ রাখার মতো অভিযোগও করেছেন। তবে বাইডেন প্রশাসন এটি অস্বীকার করেছে।

এছাড়া গাজায় বেসামরিক হতাহতের সমালোচনা এবং অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে মানবিক সহায়তা আরও বাড়ানোর প্রচেষ্টার দিকে ইঙ্গিত করছে দেশটি। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরায়েলের আক্রমণে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন।

রয়টার্স বলছে, সর্বশেষ পদত্যাগকৃত মার্কিন ওই কর্মকর্তার নাম মরিয়ম হাসনাইন। তিনি মার্কিন স্বরাষ্ট্র বিভাগের বিশেষ সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাইডেনের গাজা নীতির প্রতিবাদে মঙ্গলবার চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।

পরে তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতির কঠোর নিন্দা করেন। এমনকি বাইডেনের এই নীতিকে ‘গণহত্যা-সক্ষমকারী’ এবং আরব ও মুসলমানদের জন্য অমানবিক হিসাবে বর্ণনা করেন মরিয়ম।

গাজায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ইতোমধ্যেই প্রায় ৩৮ হাজারে পৌঁছেছে এবং অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডজুড়ে মানবিক সংকট গ্রাস করেছে। এই পরিস্থিতিতে মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং অন্যান্য সমালোচকরা ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য এবং ইসরায়েলের বর্বর আগ্রাসনের পক্ষাবলম্বনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করছেন।

আর ইসরায়েলের প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত সমর্থন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থাজুড়ে একের পর এক কর্মকর্তার পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে এবং এর মধ্যে সর্বশেষ পদত্যাগ করলেন মরিয়ম হাসনাইন।

এর আগে গত জুন মাসের শেষের দিকে পদত্যাগ করেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু মিলার। তিনি ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি। যদিও মিলার তার চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তের জন্য ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করেন।

এছাড়া মিলার চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নির্বাহী আদেশ জারিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। আর সেই আদেশে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের ওপর হামলার জন্য বেশ কিছু ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।

অ্যান্ড্রু মিলার পূর্বে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একজন সিনিয়র নীতি উপদেষ্টা ছিলেন এবং ওবামা প্রশাসনে হোয়াইট হাউস জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে মিসর ও ইসরায়েল সামরিক বিষয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এর আগে গত মে মাসে বাইডেনের ইসরায়েল নীতির প্রতিবাদে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা স্টেসি গিলবার্ট পদত্যাগ করেন। তিনি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যুরো অব পপুলেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড মাইগ্রেশনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন।

এর আগে মে মাসের মাঝামাঝিতে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিবাদে লিলি গ্রিনবার্গ কল নামে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের আরও একজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। তিনি মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের চিফ অব স্টাফের বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্বপালন করছিলেন।

লিলি গ্রিনবার্গ কল তার পদত্যাগ পত্রে লিখেছিলেন, তিনি ‘তার বিবেক ও বিচারবুদ্ধিকে সাথে নিয়ে এই প্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করা চালিয়ে যেতে পারেন না’। অবশ্য লিলি গ্রিনবার্গ কল নিজেও একজন ইহুদি এবং গত বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেসব মন্তব্য করেছেন তারও নিন্দা করেন তিনি।

এর আগে ওই একই মাসে হ্যারিসন মান নামে যুক্তরাষ্ট্রের এক সেনা কর্মকর্তা গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে ওয়াশিংটনের সমর্থনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। তিনি মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা ছিলেন।

গত নভেম্বরে তিনি ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (ডিআইএ) থেকে পদত্যাগ করেন। হ্যারিসন মান তার পদত্যাগের চিঠি নিজের লিঙ্কডইনে প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, ইসরায়েলকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রায় অকুণ্ঠ ও নিঃশর্ত সমর্থন হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও অনাহারে রাখতে ভূমিকা রেখেছে।’

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের গাজা নীতির বিরোধিতা করে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরবি ভাষার মুখপাত্র হালা রাহারিত পদত্যাগ করেন। সেসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লিঙ্কডইনে দেওয়া এক পোস্টে এ তথ্য নিজেই নিশ্চিত করেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মানজনক পদে ১৮ বছর চাকরি করার পর ২০২৪ সালের এপ্রিলে আমি পদত্যাগ করেছে। গাজা ইস্যুতে মার্কিন সরকারের নীতিই এর কারণ।’

এছাড়া গত মার্চ মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গাজা নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার কর্মকর্তা অ্যানেল শেলিন। মধ্যপ্রাচ্যের এই বিশ্লেষক মার্কিন সরকারের পক্ষে মানবাধিকার বিষয়ে প্রচারের পাশাপাশি এই সংক্রান্ত দায়িত্বও পালন করতেন।

শেলিনের পদত্যাগের আগে গত বছরের অক্টোবরে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের আরেক কর্মকর্তা জশ পল পদত্যাগ করেন। বাইডেনের গাজা নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করা ওই কর্মকর্তা ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়ক ব্যুরোর একজন পরিচালক।

এছাড়া একই কারণে গত জানুয়ারিতে পদত্যাগ করেন মার্কিন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা তারিক হাবাশ। জ্যেষ্ঠ এই মার্কিন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগের পরিকল্পনা, মূল্যায়ন ও নীতি উন্নয়নের অফিসের বিশেষ সহকারী পদে ছিলেন।

এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াশিংটন ডিসিতে ইসরায়েলের দূতাবাসের বাইরে গাজায় আগ্রাসনের প্রতিবাদে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দেন মার্কিন বিমানকর্মী অ্যারন বুশনেল। পরে তিনি মারা যান।

টিএম