ফ্রান্সে নির্বাচনে অভিবাসনবিরোধী জোটের উত্থানে ইউরোপজুড়ে উদ্বেগ
ফ্রান্সের আগাম সংসদ নির্বাচনের প্রথম দফায় কট্টর ডানপন্থী ও অভিবাসনবিরোধী দল হিসেবে পরিচিত ন্যাশনাল ব়্যালি (আরএন) এগিয়ে আছে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে মাঠ ধরে রেখেছে বাম জোট। অপরদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ভরাডুবি হয়েছে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর জোটের।
গত ৯ জুন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভরাডুবির পর ফ্রান্সের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। রোববার (৩০ জুন) প্রথম দফায় ফ্রান্সের মূল ইউরোপীয় ভূখণ্ড এবং বিভিন্ন মহাদেশে অবস্থিত ফরাসি বিভাগগুলো মিলিয়ে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির মোট ৫৭৭টি আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
বিজ্ঞাপন
সোমবার (১ জুলাই) সকালে ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করা চূড়ান্ত ফলে দেখা গেছে, প্রথম দফায় ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে আছে মারিন লা পেনের নেতৃত্বাধীন কট্টর ডানপন্থী ন্যাশনাল ব়্যালি (আরএন)। জোটসঙ্গী রক্ষণশীল রিপাবলিকান দলের একটি অংশের ভোট যোগ করলে কট্টর ডান জোটের মোট প্রাপ্ত ভোট দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশে।
অন্যদিকে, ২৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে নতুন বাম জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি)। তবে নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সমর্থিত ‘টুগেদার’ জোটের। তারা ২০ দশমিক শূন্য চার শতাংশ ভোট পেয়েছে। রিপাবলিকান (এলআর) দলের যে অংশটি একক নির্বাচন করেছে তারা পেয়েছে ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ ভোট।
যেসব প্রার্থী প্রথম দফা নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটার সংখ্যার অন্তত ১২ দশমিক পাঁচ শতাংশ ভোট পাবেন, তারা ৭ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় দফায় লড়ার সুযোগ পাবেন।
• প্রথম দফায় নির্বাচিত ৭৬ সংসদ সদস্য
যেসব প্রার্থী প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি পেয়েছেন, তাদের আর দ্বিতীয় দফায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে না। ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৫৭৭টি আসনের মধ্যে ৭৬ জন সংসদ সদস্য প্রথম দফাতেই ৫০ শতাংশের ওপর ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
এর মধ্যে রয়েছেন মারিন লা পেনের জোট থেকে ৩৯ জন, বাম জোট থেকে ৩২ জন, এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর জোট থেকে দু’জন, রক্ষণশীল এলআর থেকে একজন এবং অন্যান্য ডান দল থেকে দু’জন। সেই হিসেবে ৭ জুলাই দ্বিতীয় দফার নির্বাচন হবে ৫০১টি আসনে।
• ন্যাশনাল ব়্যালির সম্ভাব্য বিজয়ে উদ্বেগ
এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত ‘বুমেরাং’ হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। ম্যাক্রোঁর শরিকদের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং জোটের বড় শরিকদের কারও সাথে আলাপ না করেই পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার মতো আত্নঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গঠিত কর্তৃত্ববাদী ‘ভিসি রেজিম’র পর ফ্রান্সে প্রথমবারের মতো কট্টর ডান আদর্শের কোনও দল ভোটের ফলাফলে প্রথম স্থানে উঠে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে আগামী ৭ জুলাই প্যারিসের ক্ষমতা ন্যাশনাল ব়্যালির হাতে যাওয়া সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো এবং বিশ্বব্যাপী উদার গণতান্ত্রিক মহলেও। ফ্রান্স জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটি। আরএন ক্ষমতায় এলে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ফ্রান্সের অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। দলটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
এর আগে নির্বাচনে অর্থ যোগাড়ে রাশিয়ান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন মারিন লা পেন। এই ঘটনাও তার রাশিয়া সংশ্লিষ্টতাকে আরও পরিষ্কার করে তুলেছে। ক্রেমলিনের সঙ্গে আরএনের এই ঘনিষ্ঠতা কিয়েভের জন্যও বড় উদ্বেগের কারণ। এই যুদ্ধে এখন ইউক্রেনের সবচেয়ে কাছের মিত্রদের একটি প্যারিস।
• জার্মানিতে ম্যাক্রোঁকে ‘দোষারোপ’
ইউরোপীয় রাজনীতিতে ফ্রান্স এবং জার্মানিকে অপরিহার্য ‘যুগল’ হিসেবে দেখা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ফ্রান্স এবং জার্মানির ঐকমত্যকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। ফ্রান্সের নির্বাচনের প্রথম দফা ফলাফলের পর দুই দেশের যৌথ নেতৃত্বের মধ্যে ‘একটি ঐতিহাসিক বিরতি’ ঘটতে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে জার্মান দৈনিক স্যুডডয়চে সাইটুং।
জার্মানির রক্ষণশীল দৈনিক ডি ভেল্ট শিরোনাম করেছে, ‘‘ম্যাক্রোনিজমের সমাপ্তি।’’ দেশটির ডি সাইট ম্যাগাজিন লিখেছে, ‘‘ম্যাক্রোঁ পার্লামেন্ট বিলুপ্তির মাধ্যমে আরএনের কাছে ক্ষমতার দরজা খুলে দিয়েছেন।’’
আরেক রক্ষণশীল দৈনিক ফ্রাঙ্কফুর্টার আলগেমাইনে এই ‘পরাজয়ের’ জন্য ফরাসি প্রেসিডেন্টকে দায়ী করে লিখেছে, একজন রাষ্ট্রপ্রধান অপ্রয়োজনীয়ভাবে নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছে। এভাবে তিনি নিজেকে ইতিহাসের পাতায় ইতিবাচক উপস্থাপনের আশা করতে পারেন না।
দৈনিকটি আরো লিখেছে, তিনি ফরাসি পার্লামেন্ট নির্বাচনের আন্তর্জাতিক পরিণতি সম্পর্কে কোনও প্রকার না ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর ফলে ফ্রান্স অদূর ভবিষ্যতে সক্রিয়ভবে ইউরোপ এবং ন্যাটোতে বছরের পর বছর ধরে অনুপস্থিত থাকতে পারে। শুধুমাত্র রাশিয়া এই নির্বাচনে খুশি হতে পারে।
ইউরোপীয় সবগুলো রাজনৈতিক মহল রোববার বেশ সতর্ক অবস্থায় ছিল এবং কেউ রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে মন্তব্য করেনি। ব্রাসেলস থেকে রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনালের সংবাদদাতা জঁ জ্যাক হেরি জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর রোববার সন্ধ্যায় কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান এবং কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও নীরব রয়েছে।
তবে ইউরোপবিষয়ক সাবেক মন্ত্রী এবং জার্মানির পার্লামেন্ট বুন্ডেসটাগের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির বর্তমান চেয়ারম্যান মাইকেল রথ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘এটি ম্যাক্রোঁ, ইউরোপ এবং ফ্রাঙ্কো-জার্মান বন্ধুত্বের মুখে নতুন থাপ্পড়।’’
ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজেটে দ্বিতীয় বৃহত্তম অবদানকারী এবং ইউরোপের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল দেশ। এই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট রাজনীতিবিদ বিশ্বাস করেন জার্মানিও ফরাসি আইনসভা নির্বাচনের ফলাফলের দায়বদ্ধতার অংশ বহন করে। তিনি বলেন, কীভাবে আমরা ইউরোপ-পন্থী ম্যাক্রোঁকে আরও সমর্থন করতে পারি এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আমরা খুব কমই আলোচনা করেছি। আমরা পাশ্ববর্তী দেশগুলোর রাজনৈতিক বিতর্ক এবং সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিই না।
ইউরোপীয় নেতাদের শঙ্কা, ফরাসি নির্বাহী বিভাগের শীর্ষ ক্ষমতা ভাগাভাগি হলে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর অবস্থান দুর্বল হবে। এর ফলে ইইউতে ফরাসি প্রতিনিধিদের নিজেদের মধ্যে ‘অস্বস্তি’ এবং ‘ঝুঁকি’ ছাড়াও আরও অস্পষ্ট ইউরোপীয় নীতির দিকে জোটটিকে পরিচালিত করবে। ইতালিতেও ফ্রান্সের নির্বাচন নিয়ে মিশ্র অবস্থান দেখা গেছে। কট্টর ডান প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এবং তার দল অবশ্য এই নির্বাচন নিয়ে নীরবতা বজায় রেখেছে।
তবে জর্জিয়া মেলোনির জোটসঙ্গী এবং লা পেনের ঐতিহাসিক মিত্র হিসেবে পরিচিত মাত্তেও সালভিনি এই বিজয়ে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘‘মারিন লা পেনকে আমার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। ম্যাক্রোঁর লজ্জা হওয়া উচিত তিনি দ্বিতীয় দফায় আরএনের বিরুদ্ধে একটি বড় জোটের ডাক দিচ্ছেন। তিনি পরিবর্তনের বিরোধিতা করে উরসুলা ভন ডার লিয়েনের মতো আচরণ করছেন।’’
• কট্টর অভিবাসীবিরোধী নীতি
ভোটের মাঠে কট্টর ডানপন্থীদের কাছে অভিবাসন বরাবরই জনপ্রিয় ইস্যু। এবারের ফরাসি সংসদ নির্বাচনের প্রথম দফায়ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভিবাসন নিয়ে স্পষ্ট বিভাজন ফুটে উঠেছে।
ন্যাশনাল ব়্যালি (আরএন) ক্ষমতায় এলে দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা ফরাসি নাগরিকদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না বলে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছে। ১৪ জুন ফরাসি টেলিভিশন বিএফএম টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ন্যাশনাল ব়্যালির (আরএন) প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী জর্দান বারদেলা বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে প্রথম সপ্তাহেই এমন একটি অভিবাসন আইন পাস করবো, যা অপরাধী এবং ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের বহিষ্কারকে সহজতর করবে। এছাড়া আমি অভিবাসীদের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত ভূমি আইনও বাতিল করবো।
তিনি ফরাসি দৈনিক লা পারিজিয়াকে ১৭ জুন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি বিদেশি অপরাধীদের বহিষ্কারের সুবিধার্থে আইনি সময়সীমা ত্বরান্বিত করতে চান। অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন, এই ধরনের একটি বিধান বাস্তবায়ন করতে হলে তাকে প্রশাসনিক ও আইনি বাধা পেরোতে হবে। কট্টর এই রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে অনিয়মিত অভিবাসীদের চিকিৎসা বা এইড মেডিকেল সুবিধা শুধু গুরুত্বপূর্ণ জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
দলটির প্রতিষ্ঠাতা মারিন লা পেনের বাবা জঁ-মারি লা পেন মূলত আবাসন ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে অভিবাসীদের চেয়ে ফরাসি নাগরিকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তারা নির্বাচনে জিতলে সামাজিক আবাসন এবং কর্মসংস্থানে ফরাসিদের জন্য অগ্রাধিকার দেয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। ইনফোমাইগ্রেন্টস।
এসএস