দুবাইয়ের শাসক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া শেখ মোহাম্মদ আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে দুবাই পুলিশের প্রধানের পদে ছিলেন। শেখ রাশেদ বিন সাইদ আল মাকতুমের তৃতীয় পুত্র তিনি। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির কেন্দ্রে থাকা আমিরাতের ভাইস-প্রেসিডেন্টও এই শেখ মোহাম্মদ, সঙ্গে দুবাইয়ের শাসকও তিনি। তার বর্তমান ও সাবেক মিলে ছয় জন স্ত্রী রয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এ ছয় স্ত্রীর ঘরে তার রয়েছে ৩০ জন সন্তান। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ ধনকুবের এই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিজীবনের নানা দিক উঠে এসেছে তার নিজের লেখা  ‘কিচ্ছতি’ (আমার গল্প) বইটিতে। পঞ্চাশ পর্বে সে গ্রন্থ থেকেই নানা দিক তুলে এনেছেন মুহাম্মাদ শোয়াইব। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।   


৬ ডিসেম্বর, ২০১৭। বেলা ১১টা। এখনও নাশতা খাইনি। নতুন একটি প্রকল্পের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমি বহু প্রকল্প চালু করেছি। তবে এ প্রকল্পটি একেবারে অন্যরকম। কারণ, এটা আমাদের জনগণ ও রাষ্ট্রের সামনে বিদ্যমান একটি বাধা ভেঙে দেবে। 

আমি চাই না আমার নাগরিকদের সামনে কোনো বাধা থাকুক। আমি চাই প্রত্যেকে নিজেকে অন্যরকম এক উচ্চতায় নিয়ে যাক। আমি বিশ্বাস করি, মানুষকে যা উন্নয়নের দিকে নিয়ে যায়, তা বৈষয়িক প্রাচুর্যই নয়, বরং তা হলো উচ্চাকাঙ্ক্ষা, দুর্দান্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আমরা মানুষ। অন্য যে কোনো সৃষ্টির চেয়ে অনুপ্রেরণা ও উচ্চাভিলাষ দ্বারাই আমরা বেশি অনুপ্রাণিত হই। তাই আমি প্রকল্পটি এমনভাবে চালু করতে চেয়েছিলাম, যেন এটা থেকে অনেক মানুষ অনুপ্রেরণা পায়।  

আমরা বছরের পর বছর নীরবে এই প্রকল্পের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাম। আমি এটা নিশ্চিত করেছি যে এই বিষয়ে সমস্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের মঙ্গল অভিযান-টিম বা ‘হোপ মিশনের’ বৈজ্ঞানিক দল প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষা চালানো শুরু করতে প্রস্তুত। আমি এটিও নিশ্চিত করেছি, প্রকল্পটি সেই বার্তাটিই বহন করছে যেটি আমি তার মাধ্যমে জানাতে চাই। তা হলো, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামনে কোনো অসম্ভব বিষয় নেই। কোনো শক্তি দেশটির জনগণের ইচ্ছার সামনে দাঁড়াতে সক্ষম নয়। 

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপ ও ভারতের পর আমিরাতই প্রথম মহাকাশযান ডিজাইন ও নির্মাণে নামে। তারই অংশ হিসেবে মঙ্গলের পথে পাড়ি দেয় তাদের মহাকাশ যান। এ অভিযানের নাম দেওয়া হয় হোপ মিশন। 

আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় এক কোটি ৫০ লাখেরও বেশি ফলোয়ারের সামনে প্রকল্পটির একটি ঘোষণা দিয়েছি। আমরা চারজন আমিরাতিকে মহাকাশে পাঠাতে চাই। হ্যাঁ, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে মহাকাশচারী পাঠিয়ে বৃহত্তম আরব ও ইসলামিক প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে চেয়েছি। যাতে বাকি প্রকল্পগুলোর সাথে এটি একটি সুদৃঢ় মহাকাশ-ব্যবস্থা তৈরি করে। 

প্রকল্প উদ্বোধন করার ঠিক পরেই, আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষত তরুণদের কিছু প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম। তাদের মধ্যে এ প্রকল্প নিয়ে গর্ব দেখেছি আমি। আমি তরুণদের উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যগুলো পড়ছিলাম আর বলছিলাম, আমরা একটি নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছি। আমরা নতুন একটা উচ্চতায় পৌঁছেছি। ইনশাআল্লাহ আমরা আর থামব না। আমরা উন্নয়নের একটি নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছি এবং আমরা আরও বৃহত্তর পর্যায়ে পৌঁছানোর অপেক্ষায় রয়েছি। 

শেখ মোহাম্মদের ছয় জন স্ত্রী রয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এ ছয় স্ত্রীর ঘরে তার রয়েছে ৩০ জন সন্তান

শানদাগায় আমার দাদা শেখ সাঈদের বাড়ি। সেখানে মাটির দেওয়ালের ভেতরে ছিল মারজান পাথর। ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে ওই বাড়িতে বইতো মৃদু বাতাস। আমার দাদার বাড়ির ঘরের ছাদগুলো ছিল খুব নীচু। বাড়ির সামনে বড় উঠান, যেখানে আমি খেলতাম। আমি আমার দাদা শেখ সাঈদকে স্পষ্ট মনে করতে পারি। তার সাদা ধবধবে দাড়ি আর নূরানি চেহারা, আমার পরিষ্কার মনে আছে।   

আজ আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি, আমি বিশ্বাস করি, আমার দাদা এই মুহূর্তের জন্যও কাজ করেছিলেন। তিনি আজকের এই প্রকল্প তৈরিতেও আমাদের সাথে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি দুবাইয়ে বাণিজ্যের দিগন্ত প্রসারিত করেছিলেন। সকলের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করেছিলেন। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছিলেন। তার রাজত্বকালে জনসংখ্যা তিন গুণ বেড়েছিল।

আমার দাদার সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল মানুষের সাথে তার সম্পর্ক। তিনি তাদের ভালোবাসেন, তারাও তাকে ভালোবাসতেন। তাকে নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। তিনি নাকি ফজরের নামাজের আগে উঠে দূরের কোনো এক কূপে চলে যেতেন। একটি বড় বালতিতে করে ওই কূপ থেকে মসজিদে পানি আনতেন তিনি, যাতে মুসল্লিরা ফজরের নামাজের জন্য অজু করতে পারেন।  

শেখ মোহাম্মদের দাদা শেখ সাইদ বিন মাকতুম বিন হাসের আল মাকতুম। ১৯১২ সাল থেকে ১৯৫৮ সালে মৃত্যু পর্যন্ত দুবাইয়ের শাসক ছিলেন তিনি।  

আমার দাদার শাসনামলে রাষ্ট্রে কোনো ভয়-ভীতি ছিল না। ভালোবাসার মন্ত্রে তিনি রাষ্ট্র চালিয়েছেন। তার ভালোবাসা মানুষ ভুলতে পারে না। ইতিহাস থেকে সেগুলো মুছে ফেলা যাবে না।

তার চলে যাওয়ার দিনটিও পরিষ্কার মনে আছে, তখন আমার বয়স ৯ বছর। ফজরের নামাজের পরই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমার মনে আছে, নারী-পুরুষ, সবাই কাঁদছিলেন। আমার মনে আছে, কয়েকজন লোক তাকে নিয়ে যাচ্ছে, তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন।  

দাদা আজ নেই, কিন্তু ফজরের নামাজের আগে তিনি ওজুর পানি নিয়ে মুসল্লিদের জন্য অপেক্ষা করছেন- এ চিত্র আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। দাদা, তুমি আমাদের মানবসেবা শিখিয়েছ। আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন। তোমার ঠিকানাকে জান্নাতুল ফেরদাউস বানিয়ে দিন।

এনএফ