ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে নির্মূলের লক্ষ্য নিয়ে টানা আট মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। কিন্তু হামাসকে কি আসলেই পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব?

হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়।

আর এটি নিয়েই অর্থাৎ হামাসকে নির্মূল প্রশ্নে ইসরায়েলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি আরও বাড়ছে। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র দেশটির রাজনৈতিক ও সেনা নেতৃত্বের মধ্যে বিস্তৃত বিভক্তির বিষয়টি সামনে এনেছেন। এছাড়া যুদ্ধ শেষ করার জন্য গাজা উপত্যকায় হামাসকে ধ্বংস করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিবৃত লক্ষ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের শাসনকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে নির্মূল করার নামে গত প্রায় ৯ মাস ধরে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনে ৩৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তবে গত বুধবার দেশটির চ্যানেল থার্টিন-কে হ্যাগারি বলেছেন, হামাসকে নির্মূল করার কাজটি অসম্ভব।

ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেন, ‘হামাসকে ধ্বংস করা, হামাসকে অদৃশ্য করে দেওয়ার কথা বলাটা কেবলই জনসাধারণের চোখে ধুলো দেওয়ার মতো বিষয়। হামাস একটি আদর্শ, হামাস এমন একটি দল যারা জনগণের হৃদয়ে গেঁথে আছে। যারা মনে করে আমরা হামাসকে নির্মূল করতে পারব, সেটা ভুল।’

জর্ডানের আম্মান থেকে আল জাজিরার হামদাহ সালহুত বলেছেন, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারির এই মন্তব্যে নেতানিয়াহুর অফিস ‘ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া’ ব্যক্ত করেছে।

তিনি বলছেন, ‘এটি আপনাকে এই যুদ্ধে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নীতিগুলো সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং ময়দানে যুদ্ধরত সেনাবাহিনী বলছে, এটি আসলে বাস্তবসম্মত নয়।’

হ্যাগারির মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহুর কার্যালয় বলেছে, হামাসের সামরিক এবং শাসন ক্ষমতা ধ্বংস করে দেওয়ার বিষয়টি যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা ঠিক করে দিয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে অবশ্যই এর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীও বেশ দ্রুত তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে বিবৃতি জারি করেছে। সেখানে তারা বলেছে, ‘মন্ত্রিসভার নির্ধারিত যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এই লক্ষ্য অর্জনে সামরিক বাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, দিনরাত চেষ্টা করবে এবং প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।’

হ্যাগারির মন্তব্য নিয়ে সামরিক বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘তার বক্তব্যে হামাসের ধ্বংসকে একটি আদর্শিক এবং ধারণা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং  তিনি খুব স্পষ্টভাবেই এটি বলেছেন। এ বিষয়ে অন্য যেসব দাবি সামনে আনা হচ্ছে তা বিষয়গুলোকে প্রেক্ষাপটের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।’

ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আকিভা এলদার বলেছেন, হামাসকে ‘একবার এবং সর্বদা’ পরাজিত করা যেতে পারে বলে নেতানিয়াহুর যে ‘মতবাদ’ রয়েছে হ্যাগারি কার্যত সেটিকেই দুর্বল করে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘এখন, মনে হচ্ছে বহু বছর পর প্রথমবারের মতো নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার এবং অন্যদের মধ্যে একটি উত্তেজনা চলছে। হ্যাগারি কার্যত নেতানিয়াহুকে চ্যালেঞ্জ করছেন এবং বলছেন, আসলে ... আপনি হ্যালুসিনেশন বা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন।’

অবশ্য গাজায় যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে নেতানিয়াহু সরকারের ভেতরে অসন্তোষ নতুন কিছু নয়। গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে প্রস্তাব খোলাসা করেছেন তাতে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু রাজি হলে ইসরায়েলের দুই উগ্র ডানপন্থি মন্ত্রী ক্ষমতাসীন জোট ছাড়ার ও ভেঙ্গে দেওয়ার হুমকি ইতোমধ্যেই দিয়েছেন।

এছাড়া অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিস এবং জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির বলেছেন, হামাসকে ধ্বংস করার আগে যেকোনও চুক্তি ইসরায়েলের স্বার্থ বিরোধী।

তবে পাল্টা অবস্থান ইসরায়েলের বিরোধী জোটের। যুদ্ধ বিরোধী এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করলে বিরোধী নেতা ইয়ার ল্যাপিড ক্ষমতাসীন নেতানিয়াহু সরকারকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এর আগে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নিজেই জোর দিয়ে বলেছিলেন, হামাসের শাসন ও সামরিক ক্ষমতা ধ্বংস না করা এবং সব বন্দিকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত কোনো স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে যাবে না তারা।

এছাড়া গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধ নিয়ে মতবিরোধের জেরে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জরুরি সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন শটির যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য বেনি গ্যান্টজ। এমনকি নেতানিয়াহু গাজায় ইসরায়েলকে ‘সত্যিকারের বিজয় অর্জনে বাধা দিচ্ছেন’ বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।

এর আগে গাজার জন্য কোনো যুদ্ধোত্তর পরিকল্পনা তৈরি করা না হলে গত মাসে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন বেনি গ্যান্টজ। আর এই পরিকল্পনা প্রস্তুতের জন্য ৮ জুন পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি।

অবশ্য যুদ্ধ শেষ হলে গাজার ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলি নেতাদের ওপর চাপ দিয়ে আসছে। মূলত গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় হামাস। আর সেই হামলার পরদিনই ইসরায়েলে গঠিত হয় যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা।

এছাড়া গ্যান্টজের পদত্যাগের এই ঘোষণা এমন এক সময়ে এসেছে যখন গত মাসেই যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার আরেক সদস্য ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টও নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেছেন। গাজায় বেসামরিক ও সামরিক শাসন নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা ইসরায়েলের নেই, এমন ঘোষণা নেতানিয়াহুকে জনসমক্ষে দেওয়া আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

টিএম