বারবার নতুন নতুন দলের সাথে জোট গঠন আর বদলের জন্য ভারতের রাজনীতিতে ‘‘পল্টু কুমার’’ বা ‘‘পল্টু রাম’’ নামে পরিচিতি পাওয়া বিহারের নেতা নীতিশ কুমার বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের প্রতি শর্তহীন সমর্থন জানিয়েছেন। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের শরিক দলগুলোর আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে বৈঠকে নরেন্দ্র মোদির প্রতি ওই সমর্থন জানিয়েছেন তিনি। তবে তার একটি ইচ্ছা আছে বলেও মোদিকে জানিয়েছেন বিহারের এই মুখ্যমন্ত্রী।

দেশটির সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে বলেছে, নীতিশ কুমারের এবারের রাজনৈতিক পিচে আর কোনও রিভার্স সুইং হবে না। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (এনডিএ) নবনির্বাচিত এমপিদের বৈঠকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার শাসক জোটের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বৈঠকে নরেন্দ্র মোদির প্রতি শর্তহীন সমর্থনের অঙ্গীকার করেছেন তিনি।

গত জানুয়ারিতে রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইনডিয়া জোট থেকে বেরিয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে যোগ দেন বিহারের এই মুখ্যমন্ত্রী। যদিও ভারতের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের নেতৃত্বে দেশের দুই ডজনের বেশি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে বিরোধীদের এনডিএ জোট গড়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।

শুক্রবার ভারতের পুরোনো সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হলে এনডিএ জোটের এমপিদের সাথে নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নীতিশ কুমার। বৈঠকে নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘যা কিছুই ঘটুক না কেন, আমরা আপনার সাথেই থাকবো। আমরা আপনার সাথে আছি।’’

মঙ্গলবার (৪ জুন) ভারতের ৫৪৩ আসনের লোকসভার নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এই নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। দেশটিতে সরকার গঠনের জন্য ২৭২ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হলেও বিজেপি এককভাবে ২৪০ আসন পেয়েছে।

এখন সরকার গঠনের জন্য এনডিএ জোটের শরিকদের ৫৩ আসনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বিজেপিকে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ২৯৩ আসনে জয় পেয়েছে। অন্যদিকে, দেশটির বিরোধীদল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ইনডিয়া ২৩৩ আসন পেয়েছে। এর মধ্যে কংগ্রেস এককভাবে পেয়েছে ৯৯ আসন।

যে কারণে বিজেপিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এনডিএ জোটের অংশীদার অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি ও বিহারের নীতিশ কুমারের জনতা দলের (সংযুক্ত) ওপর বিশেষভাবে নির্ভর করতে হচ্ছে। লোকসভায় অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি ১৬টি ও বিহারে নীতিশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) ১২টি আসন পেয়েছে। অতীতে এই দুই নেতার জোট বদলের ইতিহাস থাকায় ফলাফল ঘোষণার পরপরই তাদের সাথে বৈঠক করেন নরেন্দ্র মোদি।

শুক্রবার দিল্লিতে এনডিএ জোটের বৈঠকে নাইডু ও নীতিশ ছিলেন সবার নজরে। বৈঠকে নীতিশ বলেন, ‘‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য এনডিএ নেতা নরেন্দ্র মোদির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে জনতা দল (ইউনাইটেড)।’’

২০০৫ সাল থেকে বিহারের রাজনীতির নেতৃত্বে থাকা নীতিশ কুমার গত জানুয়ারিতে বিজেপির সাথে অংশীদারত্ব গড়ে রাজ্যের নতুন সরকারের প্রধান হিসেবে নবমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নেন। শপথের আগে কংগ্রেসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিরোধীদের জোট ইনডিয়ায় ছিলেন তিনি। ইনডিয়া জোট থেকে বেরিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাথে জোট গড়ে গত ১৮ জানুয়ারি বিহারের নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়ার জন্য গত এক দশকে পাঁচবারের মতো রাজনৈতিক শিবির পাল্টেছেন নীতিশ। রাজনীতিতে এই ডিগবাজির কারণে ভারতে তিনি ‘‘পল্টু কুমার’’ বা ‘‘পল্টু রাম’’ নামে ব্যাপক পরিচিত।

তবে এবারে এনডিএ জোটের শরিক হিসেবে নরেন্দ্র মোদির প্রতি সমর্থন জানানোর সময় নীতিশের কণ্ঠ ছিল জোরাল, শারীরিক ভঙ্গিতেও ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। বৈঠকে নরেন্দ্র মোদির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানানোয় আপাতত তার জোট বদলের গুঞ্জনের অবসান ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, বৈঠকে মোদির হাত ধরে যেভাবে কথা দিয়েছেন নীতিশ কুমার তা যেন মিত্রদের বন্ধন আর আস্থার কথাই বলছিল।

বৈঠকে তার স্বাভাবিক শৈলী ও অপরিপক্ব ঢংয়ে কথা বলার সময় হাস্যরসও করেছেন নীতিশ কুমার। এ সময় তার চটুল কথাবার্তায় এনডিএ জোটের প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য নির্বাচিত বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদিকে কয়েকবার হাসতে দেখা যায়।

নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ্য করে নীতিশ বলেন, ‘‘আপনি (মোদি) রোববার শপথ নিতে যাচ্ছেন। তবে এটি আজকেই হলে আমার কাছে ভালো লাগতো। কিন্তু আপনি যখনই চান, তখনই ভালো। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হোক।’’

বক্তৃতার পর বয়সে ছোট নরেন্দ্র মোদিকে প্রণাম করার জন্য তার পা ছুঁতে যান নীতিশ কুমার। কিন্তু মোদি হাত ধরে ফেলে পা ছোঁয়া থেকে বিরত রাখেন নীতিশকে।

• সমর্থনের বিনিময়ে নীতিশের চাওয়া

নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের প্রতি সমর্থনের বিনিময়ে নীতিশ কুমারের একটি চাওয়া আছে, যা পূরণ করার দাবি জানিয়েছেন। সেই চাওয়ার বিষয়ে বলতে গিয়ে নীতিশ বলেন, ‘‘গত ১০ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর তিনি (মোদি) আরেক মেয়াদে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য আনন্দদায়ক। তিনি পুরো দেশের সেবা করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি দেশের সব রাজ্যের সেবা করবেন।’’

বিহারের এই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনার নেতৃত্বে বিহার এবং ভারতে প্রচুর উন্নয়ন হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। বিহারের অসমাপ্ত সব কাজ সম্পন্ন করা হবে।’’

নিজের একটি ইচ্ছা আছে জানিয়ে বক্তৃতা শুরু করলেও নীতিশ কুমার পরিষ্কারভাবে তার সেই ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেননি। তবে বৈঠকে বক্তৃতার সময় বিহারের বিষয় বারবার উল্লেখ করায় স্বাভাবিকভাবেই বিহারের টেকসই কিছুর দাবির ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। আর এই দাবির মধ্যে বিহারকে রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া ও ব্যাপক উন্নয়নে গুরুত্বারোপ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এসএস