ভারতে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে সাত দফায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ৪২টি আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়েছিল। নির্বাচন শুরুর দেড় মাস পর মঙ্গলবার প্রকাশিত হয় ফলাফল। শীর্ষস্থানীয় সব বুথফেরত সমীক্ষায় বিজেপিকে রাজ্যের একক বৃহত্তম দল হিসেবে দেখানো হয়েছিল।

বিভিন্ন বুথফেরত সমীক্ষাকে ফুৎকারে উড়িয়ে রাজ্যে ৪২ আসনের মধ্যে ২৯টি আসনে জয় পেয়েছে মমতা-অভিষেকের দল। এক একটি আসনে তৃণমূল প্রার্থীদের জয়ের মার্জিনও চোখ ধাঁধানো। বিজেপি জয় পেয়েছে ১২টি আসনে।

তৃণমূলের আসন বৃদ্ধি

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল জোর ধাক্কা খেয়েছিল। উত্থান হয়েছিল বিজেপির। সেবার ২২টি আসনে জেতে ঘাসফুল শিবির। তবে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ায় তারা। সেই ধারা বজায় রইল লোকসভা ভোটেও।

এই ভোটে প্রায় ৩০টি আসন তারা জিতেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের প্রাপ্ত ভোটের হারও বেড়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ৪৩ শতাংশ ভোট। এবার তাদের ভোট বেড়ে হয়েছে ৪৬ শতাংশ।

বিজেপির খারাপ ফল

বিজেপি গত লোকসভা ভোটে ১৮টি আসনে জয়ী হয়েছিল। ২০১৪ সালের থেকে ১৬টি বেশি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে তাদের ফল সবচেয়ে ভালো হবে। এই দাবি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

বিজেপি গতবারের তুলনায় আটটির মতো আসন কম পেতে চলেছে। ভোটও অনেকটা কমেছে। গত লোকসভায় বিজেপি ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এবার তাদের ভোট কমে হয়েছে ৩৮ শতাংশ। যে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলকে মুছে দিয়েছিল বিজেপি, এবার ঘাসফুল শিবির সেই দুর্গ ভেঙে দিয়েছে।

নিষ্প্রভ বাম-কংগ্রেস

বাম ও কংগ্রেস জোট বেঁধে ৪০ আসনে ভোটে লড়েছিল। প্রচারে বেশ সাড়াও জাগিয়েছিল তারা। কিন্তু তারা মাত্র একটি আসনে জিতেছে।

গত লোকসভায় বাম ও কংগ্রেস আলাদা লড়েছিল। সেবার তারা মোট নয় শতাংশের মতো ভোট পেয়েছিল। বামেরা কোনো আসনে জেতেনি, কংগ্রেস দুটি আসনে জিতেছিল। এইবার একসঙ্গে লড়ে তারা ১১ শতাশের মতো ভোট পেয়েছে। বামেরা খাতা খুলতে পারেনি এবারও। কংগ্রেস একটি আসন হারিয়েছে।

বড় জয়-পরাজয়

লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ইন্দ্রপতন। পাঁচবারের সাংসদ ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী হেরে গেছেন বহরমপুর কেন্দ্রে। তাকে হারান সাবেক ক্রিকেট তারকা ইউসুফ পাঠান। মুর্শিদাবাদ আসনে আশা জাগিয়েও হারতে হলো সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে। জোটের মুখ রেখেছে মালদহ দক্ষিণ। এখানে কংগ্রেসের ঈশা খান চৌধুরী জিতেছেন।

উত্তরবঙ্গের নজরকাড়া আসন কোচবিহারে বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক হেরে গেছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বিদায়ী মন্ত্রিসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ডেপুটি ছিলেন তিনি। সাবেক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার পরাজিত হয়েছেন বাঁকুড়া আসনে। বালুরঘাটের বিদায়ী সাংসদ সুকান্ত মজুমদার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। তিনি বিজেপির রাজ্য সভাপতি।

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি পদ থেকে অবসর নিয়ে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বিজেপির টিকিটে ভোটে লড়েন। তিনি তমলুক কেন্দ্রে জয়ের পথে। একইভাবে অধিকারী গড় অটুট রেখে কাঁথিতে পদ্ম প্রতীকে জিতেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ভাই সৌমেন্দু।

আসন বদলে হার হয়েছে বিজেপির সাবেক রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের। তাকে হারিয়েছেন সাবেক ক্রিকেট তারকা তৃণমূল প্রার্থী কীর্তি আজাদ। আসানসোলে জিতেছেন বলিউডের সাবেক তারকা তৃণমূলের শত্রুঘ্ন সিনহা। তিনি হারান বিজেপি প্রার্থী সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়াকে।

তারকার লড়াইয়ে জিতেছে তৃণমূল। ঘাটালে দেব ও হুগলি আসনে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতেছেন। কৃষ্ণনগর আসন থেকে জিতে ফের লোকসভায় যাচ্ছেন মহুয়া মৈত্র। তিনি সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন কয়েকমাস আগে।

মতুয়া ভোটের সৌজন্যে বনগাঁ দখলে রাখতে পেরেছে বিজেপি। এখানে তাদের প্রার্থী বিদায়ী মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর।

সিপিএমের টিকিটে লড়া তরুণ বাম প্রার্থীরা প্রচারে সাড়া জাগালেও প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারেননি। যাদবপুরে সৃজন ভট্টাচার্য, শ্রীরামপুরে দীপ্সিতা ধর, ডায়মন্ড হারবারে প্রতীক উর রহমান, তমলুকে সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যুদস্ত হয়েছেন।

রেকর্ড জয় অভিষেকের

দেশের মধ্যে রেকর্ড ভোটে জয়ের নজির গড়তে চলেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ডায়মন্ড হারবার আসনে সাত লাখেরও বেশি ভোটে জিতেছেন  তিনি। ২০০৪ সালে লোকসভা ভোটে ৫ লাখ ৯০ হাজার ভোটে আরামবাগে জিতেছিলেন সিপিএমের অনিল বসু।

বিরোধীদের অভিযোগ, ডায়মন্ড হারবার আসনে ভোটের দিন অধিকাংশ বুথে এজেন্ট বসাতে দেয়নি তৃণমূল। এদিন ভোট গোনার সময়ও সর্বত্র বিরোধী এজেন্টদের বসতে দেওয়া হয়নি।

কোন ফ্যাক্টরে জয়

তৃণমূলের জয়ের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় অবদান হিসেবে দেখা হচ্ছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পকে। এই প্রকল্পে নারীরা প্রতি মাসে ৫০০ টাকা পেতেন। নির্বাচনের আগে তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়। ভোটের মুখে সেই টাকা অ্যাকাউন্টে পাঠানো শুরু করে তৃণমূল সরকার। দুই কোটির বেশি নারী এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছেন। তাদের ভোট তৃণমূলের পক্ষে গেছে।

রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটে থাবা বসাতে পারেনি বাম ও কংগ্রেস জোট। দাগ কাটতে পারেনি আইএসএফ। তাই মুসলমান ভোটের প্রায় পুরোটাই তৃণমূলের সঙ্গে থেকেছে। পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের অন্যত্র ভোটপ্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরাসরি মুসলমানদের নাম করে যেসব মন্তব্য করেছিলেন, তাতে এ রাজ্যে মেরুকরণ আরও প্রবল হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘ভোটের আগেই প্রতি তিন জন মানুষের একজন বিজেপির সঙ্গে নেই। সংখ্যালঘুরা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ ৭০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে বসেছে বিজেপি, তৃণমূল কিন্তু ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিচ্ছে। ২ কোটি ১৮ লাখ ভোটার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সুবিধা পাচ্ছেন। অন্যান্য প্রকল্পও আছে। এতেই অংক পরিষ্কার হয়ে যায়।’

বিজেপির ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও সংগঠনের দুর্বলতা হারের বড় কারণ হয়ে উঠে এসেছে। নিয়োগ দুর্নীতি, একশো দিনের কাজ বা আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিরোধীরা। সন্দেশখালি নিয়ে তোলপাড় হলেও ভোটে তা দাগ কাটতে পারেনি। বসিরহাট আসনে তৃণমূল বিপুল ভোটে জিতেছে। এমনকি সন্দেশখালি বিধানসভাতেও বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র এগোতে পারেননি।

তাই বুথফেরত সমীক্ষা যাই বলুক, বাস্তবে রাজ্যের মানুষ অন্যরকম ভেবেছেন বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। সাংবাদিক নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়নি, যেটা মনে করা হচ্ছিল। সেখানেই হিসেবে ভুল হয়ে গেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই মানুষ বিশ্বাস করেছে। বিজেপি এখনও পশ্চিমবঙ্গের দল হয়ে উঠতে পারেনি। কোথাও একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ রয়ে গেছে।’

আর দুই বছর পর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে বিরোধীদের খুব একটা আশা দেখছেন না রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও পর্যবেক্ষক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আর বছর দুয়েক সময় হাতে আছে। এর মধ্যে বিজেপি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। এবার প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রচার করার পরও যে ফল হলো, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূলকে বিধানসভা ভোটে হারানো খুবই কঠিন।’

টিএম