সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুরগামী একটি ফ্লাইটের অন্তত এক যাত্রী নিহত ও আরও ৩০ জনের বেশি আহত হয়েছেন | ছবি: সিএনএ

মাঝ-আকাশে তীব্র-ঝাঁকুনির কবলে পড়া সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুরগামী একটি ফ্লাইটের অন্তত এক যাত্রী নিহত ও আরও ৩০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ওই ফ্লাইট মঙ্গলবার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করেছে।

এই ঘটনার বিষয়ে জানতে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ওই ফ্লাইটের এক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তিনি আকস্মিক ঝোড়োগতির বাতাসের সময় বিমানের ভেতরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স বলেছে, ‘‘আমরা বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর ফ্লাইটে এক যাত্রীর মৃত্যু ও অন্যান্যদের আহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করছি।’’ লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুরগামী সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ওই ফ্লাইটে মোট ২১১ জন যাত্রী ও ১৮ জন ক্রু ছিলেন।

লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে স্থানীয় সময় সোমবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের দিকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ৩২১ ফ্লাইটটি সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পরে মাঝ-আকাশে তীব্র বাতাসের কবলে পড়ে সেটি। এই ঘটনার পর সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ওই ফ্লাইটের পাইলট মঙ্গলবার ব্যাংককের দিকে বিমানের গতিপথ পরিবর্তন করেন।

সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স বলছে, হিথরো বিমানবন্দর ছেড়ে আসা বিমানটি থাইল্যান্ডের স্থানীয় সময় বিকেল পৌনে ৪টায় থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর জরুরি অবতরণ করেছে। কী ধরনের পরিস্থিতি এক যাত্রী নিহত ও অন্যান্যরা আহত হয়েছেন, সেই বিষয়ে কিছু জানায়নি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স। তবে বিমানের একজন যাত্রী রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘যে যাত্রীরা সিটবেল্ট পরেননি, তাদের মাথা কেবিনের ওপরের অংশে আঘাত করেছে।’’

থাইল্যান্ডের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এই ঘটনায় ৩০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে। যদিও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স কতজন আহত হয়েছেন সেবিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি।

ফ্লাইটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার টোয়েন্টিফোর বলছে, লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের প্রায় ১১ ঘণ্টা পর বিমানটি আন্দামান সাগর অতিক্রম করে থাইল্যান্ডের আকাশসীমায় পৌঁছায়। থাই আকাশসীমায় থাকাকালীন মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রায় ৩৭ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে তীব্রগতিতে ৩১ হাজার ফুটে নেমে আসে।

বিমানের ভেতরে খাবারের পাত্র ও সরঞ্জাম পড়ে আছে। পাশে কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে একজনের মরদেহ | ছবি: এফএল৩৬০অ্যারো

ফ্লাইটের যাত্রী ২৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী জাফরান আজমির রয়টার্সকে বলেছেন, বিমানটি হঠাৎ করেই কাত হতে শুরু করে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিও শুরু হয়। কী ঘটছে আমি সেটা জানার চেষ্টা করলাম। এর পরপরই অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে বিমানটি নিচে নেমে যায়। এসময় সবাই বসে ছিলেন। সিটবেল্ট না পরা যাত্রীরা সঙ্গে সঙ্গে সিলিংয়ে পড়ে যান।

তিনি বলেন, ‌‌‘‘কিছু লোকের মাথা ব্যাগেজ কেবিনের ওপর আঘাত করে। কেবিনের লাইট এবং মাস্ক রাখার স্থানে আঘাত লাগায় সব কিছু ভেঙে যায়।’’

থাইল্যান্ডের ইমিগ্রেশন পুলিশ বলেছে, মেডিক্যাল কর্মীরা ফ্লাইটের আহত যাত্রীদের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে বিমানে উঠেছেন। তবে কতজন আহত হয়েছেন সেই সংখ্যা নিশ্চিত করতে পারেননি। আহত যাত্রীদের উদ্ধারের পর ব্যাংককের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স বলেছে, ‘‘বিমানে থাকা সকল যাত্রী ও ক্রুদের সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা প্রদান করাই আমাদের মূল অগ্রাধিকার। আমরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার জন্য থাইল্যান্ডের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করছি এবং অতিরিক্ত সহায়তার জন্য একটি দলকে ব্যাংককে পাঠানো হয়েছে।’’

সিঙ্গাপুরের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম চ্যানেল নিউজ এশিয়া বলছে, বিমানটিতে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে আরও তথ্য সামনে আসছে। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডাটা অনযায়ী, বিমানটি পাঁচ মিনিটের মাঝে ৬ হাজার ফুট নিচে নেমে যায়; যা প্রায় এক দশমিক ৮ কিলোমিটার দূরত্বের সমান। ভোর ৪টা ৬ মিনিট থেকে ৪টা ১১ মিনিটের মাঝে বিমানটি ৩৭ হাজার ফুট উঁচু থেকে ৩১ হাজার ফুটে নেমে আসে।

বিমানের একজন যাত্রী বলেছেন, যে যাত্রীরা সিটবেল্ট পরেননি, তাদের মাথা কেবিনের ওপরের অংশে আঘাত করে

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের ২০২১ সালের করা এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বিমান দুর্ঘটনার সবচেয়ে সাধারণ ধরন হলো তীব্র ঝাঁকুনি। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের এই সংস্থা দেখেছে, বিমান দুর্ঘটনার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ছিল তীব্র ঝাঁকুনি সম্পর্কিত। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনায় এক বা একাধিক যাত্রী গুরুতর আহত হলেও বিমানের তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

বিশ্বের অন্যতম প্রধান এয়ারলাইন্স হিসাবে ব্যাপক স্বীকৃতি রয়েছে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই এয়ারলাইন্সের কোনও বিমানের বড় ধরনের দুর্ঘটনার রেকর্ড নেই।

সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের সর্বশেষ বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২০০০ সালের ৩১ অক্টোবর। ওই দিন সিঙ্গাপুর থেকে তাইপে হয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস যাওয়ার সময় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তাইওয়ানের তাওউয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভুল রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের চেষ্টার সময় নির্মাণ সরঞ্জামের ওপর বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। এই দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা ১৭৯ যাত্রীর মধ্যে অন্তত ৮৩ জন নিহত হন।

এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের রেকর্ড অনুযায়ী, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এখন পর্যন্ত মোট সাতবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। সর্বশেষ এই দুর্ঘটনার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন বিমান প্রস্তুতকারক সংস্থা বোয়িংয়ের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি।

এসএস