ইসরায়েলের হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার বেশিরভাগই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে আগেই। এখন বাকি রয়েছে অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডটির রাফা শহর। গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় এই শহরেই ইতোমধ্যেই হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েল।

আর এরই জেরে শহরটি ছেড়ে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ ইতোমধ্যেই পালিয়ে গেছেন বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে গাজার অন্যান্য অংশ থেকে এসব মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

এছাড়া গাজার উত্তরাঞ্চলে নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও ১ লাখ মানুষ। বুধবার (১৫ মে) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি রাফা থেকে পালিয়ে গেছেন বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। এছাড়া ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ট্যাংকগুলো দক্ষিণ গাজার এই শহরের আরও ভেতরে হামলা শুরু করেছে।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, ‘মানুষ ক্রমাগত ক্লান্তি, ক্ষুধা এবং ভয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।’

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা রাফা শহরের পূর্বে ‘সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুতে অভিযান’ চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে বাঁচতে গাজা উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্তের এই শহরটি গত সাত মাস ধরে ১০ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষের কাছে আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে উত্তর গাজায় ইসরায়েলের নতুন অভিযানে আরও এক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ইসরায়েলি সৈন্যরা উত্তর গাজার জেইতুন এবং জাবালিয়া এলাকায় আবারও ফিরে গেছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, হামাস গ্রুপের স্থানীয় ব্যাটালিয়নগুলো সেখানে আবারও সংগঠিত হয়েছে। যদিও মাত্র পাঁচ মাস আগেই তাদের নির্মূল করার দাবি করেছিল ইসরায়েল।

বিবিসি বলছে, হামলা শুরু করার আগে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে পূর্ব রাফা এবং জাবালিয়া থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- সাম্প্রতিক দিনগুলোতে যেসব ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তা গাজার মোট জনসংখ্যা তথা ২৩ লাখের প্রায় এক-চতুর্থাংশের সমান।

মূলত গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন আন্তঃসীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি এই আক্রমণের ফলে গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজার ১৭০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং আরও প্রায় ৮০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গাজায় গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮২ জন।

বিবিসি বলছে, মঙ্গলবার জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করেছে যেটাতে রাফার খালি ও জনশূন্য রাস্তাগুলো দেখা যাচ্ছে। যদিও গত ৬ মে ইসরায়েলি অভিযান শুরুর আগে রাফার এই রাস্তাগুলো তাঁবুসহ মানুষের অস্থায়ী আশ্রয়ে পরিপূর্ণ ছিল।

ইউএনআরডব্লিউএ বলেছে, পরিবারগুলো এখান থেকে নিরাপত্তার সন্ধানে পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু গাজার কোনো স্থানই নিরাপদ নয়। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিই একমাত্র আশা।

রাফাতে অবস্থানরত ইউএনআরডব্লিউএ’র মুখপাত্র লুইস ওয়াটারিজ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে (পূর্বের টুইটার) লিখেছেন, শহরে এখনও যেসব পরিবার অবস্থান করছেন তারা ‘যতদূর সম্ভব আরও পশ্চিমে চলে গেছেন’ এবং তারা এখন ভূমধ্যসাগরের উপকূলের সৈকতে তাঁবু স্থাপন করেছেন। আর শহরের ভেতরের পরিস্থিতি এমন যে ‘এখন এটি ভূতের শহর।’

রাফার পশ্চিমে তাল আল-সুলতান এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন এক নবজাতক শিশুর বাস্তুচ্যুত মা হাদিল রাদওয়ান। তিনি বলেছেন, ক্রমাগত গোলাবর্ষণে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন এবং খাবার পানীয়সহ অন্যান্য সহায়তার সংকটে রয়েছেন।

তিনি বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেছেন, আশপাশের মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কয়েকদিন আগেই ‘আমার সি-সেকশন (সিজার) হয়েছে এবং হামলার হুমকির মুখে দ্রুত অন্য কোথাও চলে যাওয়া আমার পক্ষে কঠিন হবে।’

অন্যান্য ফিলিস্তিনিরা বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ট্যাংকগুলো দক্ষিণ-পূর্ব রাফার আবাসিক এলাকায় আরও গভীরে অগ্রসর হয়েছে এবং মিসরের নিকটবর্তী রাফা ক্রসিংয়ের প্রধান উত্তর-দক্ষিণ রাস্তাও অতিক্রম করেছে। এর আগে গত সপ্তাহে ইসরায়েলি সেনারা রাফা ক্রসিং নিয়ন্ত্রণে নেয়।

গাজায় সাত মাস যুদ্ধের পর ইসরায়েল জোর দিয়ে বলছে, রাফা দখল এবং হামাসের শেষ অবশিষ্ট ব্যাটালিয়নগুলোকে নির্মূল করা ছাড়া ‘বিজয় অর্জন’ অসম্ভব। কিন্তু জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা শক্তিধর দেশগুলো সতর্ক করে বলেছে, রাফাতে সর্বাত্মক হামলা হলে ব্যাপক বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে এবং মানবিক বিপর্যয় প্রকট আকার নিতে পারে।

জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, শহরে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির পাশাপাশি জ্বালানি, খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ শেষ হয়ে যাচ্ছে কারণ রাফা ক্রসিং বন্ধ রয়েছে। এছাড়া নিকটবর্তী কেরাম শালোম ক্রসিংটিও বেশ দুর্গম।

অবশ্য ইসরায়েল গাজায় পূর্ণাঙ্গ জয় পাবে কি না, তা নিয়ে খোদ বাইডেন প্রশাসনেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ট ক্যাম্পবেল গত সোমবার জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনি উপত্যকা গাজায় হামাসকে পরাজিত করে ইসরায়েল ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ অর্জন করবে বলে তেমন কোনো সম্ভাবনা বাইডেন প্রশাসন দেখছে না।

মূলত ক্যাম্পবেলের এই মন্তব্য বাইডেন প্রশাসন তথা শীর্ষস্থানীয় কোনো মার্কিন কর্মকর্তার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পরিষ্কার স্বীকারোক্তি যে, ইসরায়েলের বর্তমান সামরিক কৌশল এমন ফলাফল আনবে না যে লক্ষ্যে তারা লড়াই করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে ন্যাটো ইয়ুথ সামিটে ক্যাম্পবেল বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে, আমরা বিজয়ের তত্ত্ব কি তা নিয়ে সংগ্রাম করছি। কখনও কখনও আমরা যখন ইসরায়েলি নেতাদের কাছ থেকে শুনি, তারা বেশিরভাগ সময়ই... যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক বিজয়, সম্পূর্ণ বিজয়ের ধারণা সম্পর্কে কথা বলেন।’

তিনি বলেন, ‘তবে আমি মনে করি না... আমরা বিশ্বাস করি, তেমন কিছুর (সম্পূর্ণ বিজয় অর্জন) সম্ভাবনা আছে বা তেমন কোনও কিছু সম্ভব। এবং এটি অনেকটা সেই পরিস্থিতির মতোই দেখায় যেখানে আমরা ৯/১১-এর পরে (আফগানিস্তান এবং ইরাকে) নিজেদেরকে পেয়েছি।’

অবশ্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বারবার হামাসের বিরুদ্ধে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নিরলস আক্রমণে ৩৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বর্বর ইসরায়েলি আগ্রাসনে ঘনবসতিপূর্ণ ক্ষুদ্র এই ভূখণ্ডটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

টিএম