লোকসভা নির্বাচন : চতুর্থ দফা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষিপ্ত অশান্তি
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের চতুর্থ দফার ভোটগ্রহণ পর্বে নয়টি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট ৯৬টি আসনে ১ হাজার ৭১৭ জন প্রার্থীর ভাগ্য পরীক্ষা হলো সোমবার।
অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগর আসনে ভোট গ্রহণ হয়েছে এদিন। এর মধ্যে বেশিরভাগ কেন্দ্রে ভোট শান্তিপূর্ণ হলেও, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষিপ্তভাবে অশান্তির ঘটনার অভিযোগ সামনে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
চতুর্থ দফা ভোটগ্রহণের শুরু থেকেই বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, নদীয়া, বর্ধমানসহ একাধিক জায়গা থেকে নানা অভিযোগ উঠে এসেছে। নির্বাচনের আগেরদিন রাত থেকেই এক তৃণমূল কর্মীকে খুনের অভিযোগ কেন্দ্র করে উত্তপ্ত ছিল পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রাম।
বর্ধমানের মন্তেশ্বরে বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখান তৃণমূল কর্মীরা। তার কনভয়ে কিছু গাড়ির কাচ ভাঙা হয়েছে বলেও অভিযোগ। এই ঘটনায় রিপোর্ট তলব করেছে নির্বাচন কমিশন।
অন্যদিকে, ভোটের দিন সকাল থেকে কোথাও এক দলের সমর্থকদের বিপক্ষের কর্মীদের মারধর, বুথ এজেন্টদের না ঢুকতে দেওয়া, এমনকি ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টার মতো একাধিক ঘটনার খবর পাওয়া গিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে সকাল ১১টার মধ্যেই এক হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে বাড়তে থাকে এই সংখ্যা। বেলা আড়াইটার মধ্যে সেটি পৌঁছায় ১ হাজার ৭০৫ এ।
চতুর্থ দফার ভোটে একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী লড়ছেন। এ তালিকায় সমাজবাদী পার্টির সভাপতি অখিলেশ যাদব (উত্তর প্রদেশের কনৌজ), প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান (যিনি তৃণমূলের হয়ে বহরমপুর থেকে লড়ছেন), বহরমপুরের কংগ্রেস প্রার্থী তথা লোকসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী, অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ শত্রুঘ্ন সিনহা (আসানসোল), গিরিরাজ সিং (বিহারের বেগুসরাই), অর্জুন মুণ্ডার (ঝাড়খণ্ডের খুঁটি) মতো প্রার্থীরা রয়েছেন।
রয়েছেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল প্রার্থী মহুয়া মৈত্র, কৃষ্ণনগরের বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায়, বর্ধমান পূর্বের বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ, বীরভূমের তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায়সহ আরও অনেকে।
এই পর্বে মোট ১৭ কোটি ৭০ লক্ষ ভোটার ভোট দেবেন, যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮ কোটি ৯৭ লক্ষ এবং ৮ কোটি ৭৩ লক্ষ জন নারী।
বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত রাজ্যের আট কেন্দ্রে গড় ভোট পড়ে ৭৫.৬৬ শতাংশ, দেশে ভোটের হার ৬২.৩০। অন্যদিকে, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৫.৭৫% ভোট পড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষিপ্ত অশান্তি
দেশে সামগ্রিকভাবে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও, পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জেলা থেকে সংঘর্ষের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে।
চতুর্থ দফা ভোটগ্রহণের আগের রাতে অর্থাৎ রবিবার মিন্টু শেখ নামে এক তৃণমূল কর্মীকে খুনের ঘটনা ঘিরে তীব্র উত্তেজনা ছড়ায় পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামে। বোলপুর কেন্দ্রের অন্তর্গত কেতুগ্রামের চেঁচুড়ি গ্রামের বাসিন্দা মিন্টু শেখকে রবিবার রাতে খুন করা হয় বলে অভিযোগ।
তৃণমূলের অভিযোগ, এই ঘটনার জন্য দায়ী সিপিএম। অন্যদিকে, সেই অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকেই দায়ী করেছে সিপিএম। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুইজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ
মন্তেশ্বরের পর কালনায় দিলীপের কনভয়ে আবার হামলা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ। তার গাড়ি লক্ষ্য করে ইট ছোড়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন বিজেপি নেতা। এই ঘটনায় দুই নিরাপত্তারক্ষী ইটের ঘায়ে জখম হয়েছেন।
অন্যদিকে, সোমবার বেলার দিকে দুর্গাপুরে তৃণমূল এবং বিজেপি কর্মীদের মধ্যে বচসা ক্রমে হাতাহাতির আকার নেয়। ওই এলাকায় তীব্র উত্তেজনা ছড়ায়। পরে রাস্তায় বসে বিক্ষোভও দেখান বিজেপি কর্মীরা।
প্রসঙ্গত, ভোট বয়কট করেছেন পূর্ব বর্ধমানের মেমারির বাগিলা গ্রাম পঞ্চায়েতের দিলালপুর গ্রামের বাসিন্দারা। দীর্ঘ সময় ধরে পাকা সেতু এবং রাস্তার তৈরির দাবি জানিয়ে আসলেও কোনো কাজ না হওয়ায় তারা ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রচার করতেও দেওয়া হয়নি। নাম মাত্র ভোট পড়েছে ওই গ্রামে।
এদিকে, কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে বিজেপি কর্মীকে মারধরের পর সেই কর্মীদেরই গ্রেফতার করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর থানায় যান বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায়। কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। পুলিশের সঙ্গে তার বচসাও হয়।
অমৃতা রায় বলেন, ‘আমাদের ছেলেদের তুলে আনা হয়েছে। ওরা বুথের ৩০০ মিটারের মধ্যে থাকা পতাকা খুলতে গিয়েছিল। খুনের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। উর্দি পরে গুণ্ডামি করতে পারে না পুলিশ।’
কৃষ্ণনগরের চাপড়ার একটি বুথে সিপিএমের এজেন্টকে না বসতে দেওয়ার ঘটনাকে ঘিরে তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বাম এজেন্টরা।
এছাড়া, বীরভূমের ইলামবাজারের ২৫ নম্বর বুথের প্রিসাইডিং অফিসারকে বুথে অব্যবস্থাপনার অভিযোগে সরিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
সোমবার অশান্তির খবর আসে বহরমপুর থেকেও। ওই জেলার ভরতপুরে কেন্দ্রীয় বাহিনী জওয়ানদের বিরুদ্ধে কুলুরু গ্রামের একটি বুথ লাগোয়া চত্বরে অবৈধ জমায়েত সরানোর উদ্দ্যেশ্যে লাঠিচার্জ করার অভিযোগ করেছেন গ্রামবাসী।
এরপর কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান তারা।
এদিকে, বহরমপুরের বড়ঞার একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের দু’টি বুথের বাইরে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের ধাক্কাধাক্কির সময় তৃণমূল কর্মীকে পুলিশ চড় মারে বলে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।
সেখানে কংগ্রেসের এজেন্টকে বসতে বাধা দিয়েছিল তৃণমূল। এই ঘটনাকে ঘিরে তীব্র বচসা হয়। এরপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে বলে অভিযোগ।
বহরমপুরের প্রার্থীরা কী বলছেন?
নির্বাচন চলাকালীন বহরমপুরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অভিযোগের প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে, প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘বেলডাঙা, বড়ঞা-সহ তিন-চারটি জায়গা থেকে বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছি। প্রতি মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন সক্রিয় ছিল। সমস্ত সমস্যা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বহরমপুর লোকসভায় বুথ এজেন্ট নিয়ে কোনও সমস্যা নেই।’
‘বিভিন্ন এলাকায় বুথের বাইরে জমায়েত করা হয়েছে। ভোটারদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে। তবে তেমন কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি। ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করছে। আমরা খুব সক্রিয়।’
এই প্রথম রজনীতির ময়দানে এসেছেন সাবেক ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান। তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চমক ছিল তাকে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করা।
সোমবার বহরমপুরের বেলডাঙ্গা কেন্দ্র পরিদর্শনে যান তিনি। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের ভোট দেওয়ার ঢল দেখে আমি খুব উৎসাহ পাচ্ছি। যে অভিযোগের কথা সংবাদমাধ্যম এবং অন্যান্য জায়গা থেকে এখনই জানতে পারলাম, নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখা হবে।’
নির্বাচন কমিশন নিয়ে ক্ষোভ মহুয়া মৈত্রর
এদিকে, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল প্রার্থী মহুয়া মৈত্র।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে আধিকারিকদের মোদী-শাহ দুই তৃতীয়াংশের বিচারে নিয়োগ করেন। স্বাভাবিক আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয় না। প্রথম দু’দফায় সাম্প্রদায়িক কথাবার্তায় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কমিশন।
তবে জয়ের বিষয়ে বেশ নিশ্চিত তিনি।
জম্মু-কাশ্মীর
এদিকে, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং জম্মু-কাশ্মির ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রধান ফারুক আবদুল্লাহ। তার দলের কর্মীদের দু'দিন ধরে আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ।
সোমবার শ্রীনগরে ভোট দেওয়ার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এর জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, ‘এখানে যদি পাথর ছোড়া না হয়, সহিংসতা না হয়, তাহলে তার কর্মীদের কেন আটকে রাখা হয়েছে?’
‘একদিকে তারা বলছে যে খুব অবাধে নির্বাচন হচ্ছে। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই, কেন আমাদের কর্মীদের তালাবদ্ধ করা হয়েছে। তারা কি ভয় পাচ্ছে? যে তারা হেরে যাবে? তারা অবশ্যই হারবে।’
লোকসভা নির্বাচনের চতুর্থ পর্বে শ্রীনগরেও ভোট হয়েছে।
বিতর্ক
হায়দরাবাদ লোকসভা আসনে ওয়াইসির বিরুদ্ধে মাধবীলতাকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। দু’জনেই নিজেদের জয়ের বিষয়ে নিশ্চিত।
এরই মধ্যে সোমবার বিতর্কে জড়িয়েছেন হায়দরাবাদ লোকসভার বিজেপির প্রার্থী মাধবীলতা।
একটি কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা মুসলিম নারীদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করার একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়। সংবাদ সংস্থা এএনআইয়ের ভিডিওতে তাকে নারী ভোটারদের পরিচয়পত্র দেখার পর সন্দেহ হওয়ায় তাদের প্রশ্ন করতে দেখা যায়।
তাদের বোরখা সরিয়ে মুখ দেখানোর অনুরোধ করেন তিনি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তার বিরুদ্ধে আইপিসি-র ১৭১ সি, ১৮৬, ৫০৫ (১) (সি) এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১৩২ ধারার অধীনে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
যদিও মাধবীলতা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, তার উদ্দেশ্য ভুয়া ভোটারদের রোখা ছিল।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএমডব্লিউ