যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারীরা কী চান?
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। মঙ্গলবার রাতে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক ডজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে দেশটিতে এক হাজারেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
স্নাতকের সমাপনী অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মাঠে শিবির স্থাপন করে বিক্ষোভ করছে শিক্ষার্থীরা। ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরোধিতায় শিক্ষার্থীদের শুরু করা এই বিক্ষোভ এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১০০ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছড়িয়ে পড়েছে। যা মোকাবিলা করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে দেশটির আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।
বিজ্ঞাপন
বুধবার লস অ্যাঞ্জেলেসে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিলিস্তিনপন্থি শিক্ষার্থীদের সাথে ইসরায়েলপন্থি শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ সহিংসতা হয়েছে। এ সময় দুই গ্রুপের শিক্ষার্থীদের মাঝে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
• গাজা যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীরা কেন বিক্ষোভ করছে?
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা ও ইসরায়েলের পাল্টা হামলার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, অনশন এবং সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছে। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইসরায়েল থেকে আর্থিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, ইসরায়েলে ব্যবসা করছে অথবা ইসরায়েলি সংস্থাগুলোর সাথে জড়িত এবং ইসরায়েলি কোম্পানিতে যারা বিনিয়োগ করছে; এমন সব কলেজ গাজায় চলমান যুদ্ধে ইসরায়েলের অবৈধ যুদ্ধের সহযোগী।
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা ল্যাব থেকে স্কলারশিপ পর্যন্ত সবকিছুতেই ইসরায়েলিদের তহবিল দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ থেকে পাওয়া মুনাফার ব্যবহার করে।
• কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ঘটেছে?
মঙ্গলবার রাতে পুলিশ ক্যাম্পাসে অভিযান চালিয়ে শিক্ষার্থীদের তাঁবু ভেঙে দেয়। বিক্ষোভকারীদের সেখানকার একটি একাডেমিক ভবন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়; যা তারা দখল করেছিল। দাঙ্গা পুলিশের কর্মকর্তারা বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বাসে করে সরিয়ে নেওয়ার আগে সিঁড়ি বেয়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যামিল্টন হলের দ্বিতীয় তলায় প্রবেশ করেন।
পরে পুলিশ বলেছে, ওই স্থান থেকে তারা সব বিক্ষোভকারীকে হটিয়ে দিয়েছে এবং সেখানে যে অচলাবস্থার তৈরি হয়েছিল, তার অবসান ঘটেছে।
ইসরায়েলি যুদ্ধের বিরোধিতায় যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভের শুরু হয় চলতি মাসের শুরুর দিকে। ওই সময় কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মিনোচে শফিক ক্যাম্পাসে ইহুদি-বিদ্বেষ সম্পর্কে কংগ্রেসের সামনে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় শত শত শিক্ষার্থী আপার ম্যানহাটন ক্যাম্পাসে তাঁবু টানান।
পরে ক্যাম্পাসে গণগ্রেপ্তার চালানো হলেও শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ঠেকানো যায়নি। বরং এই বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে ক্লাস বাতিল করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের সাথে কর্তৃপক্ষের বিরোধ মীমাংসার আলোচনা ভেস্তে যায়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান ধর্মঘট শুরু হলে আবারও পুলিশ ডাকে কর্তৃপক্ষ। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, হলটিতে ভাঙচুর চালানোর পাশাপাশি অবরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা যাতে অবস্থান শিবির স্থাপন করতে না পারে সেজন্য মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্যাম্পাসে পুলিশ থাকবে।
• শিক্ষার্থীরা আর কোথায় কোথায় আন্দোলন করছে?
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ক্রমবর্ধমান হারে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে :
• উত্তর-পূর্ব অঞ্চল : জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ; ব্রাউন ইউনিভার্সিটি; ইয়েল ইউনিভার্সিটি; হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি; এমারসন ইউনিভার্সিটি; নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি; জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি; আমেরিকান ইউনিভার্সিটি; মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি; জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি; টাফ্টস ইউনিভার্সিটি; কর্নেল ইউনিভার্সিটি; পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটি; প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি; টেম্পল ইউনিভার্সিটি; নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি; ম্যাসাচুসেটস ইউনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি); দ্য নিউ স্কুল; রচেস্টার ইউনিভার্সিটি ও পিটসবার্গ ইউনিভার্সিটি।
• পশ্চিম উপকূল : ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট পলিটেকনিক, হামবোল্ট; ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া; ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস; ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে; ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন।
• মধ্য-পশ্চিম অঞ্চল : নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি; সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি; ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি; ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান; ওহাইও ইউনিভার্সিটি; ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা; ইউনিভার্সিটি অব মিয়ামি; ইউনিভার্সিটি অব ওহাইও; কলাম্বিয়া কলেজ শিকাগো; ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো।
• দক্ষিণ অঞ্চল : এমরি ইউনিভার্সিটি; ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি; নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটি, শার্লট; নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটি, চ্যাপেল হিল; কেনেসাও স্টেট ইউনিভার্সিটি; ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটি; ভার্জিনিয়া টেক ইউনিভার্সিটি; ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়া, এথেন্স।
• দক্ষিণ-পশ্চিম : অস্টিনের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস; রাইস ইউনিভার্সিটি; অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি।
ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরোধিতায় শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি এবং যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও ছড়িয়েছে।
• কীভাবে মোকাবিলা করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো?
যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সাথে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আলোচনা করছে। অন্যরা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রত্যাহারের আল্টিমেটাম দিয়ে পুলিশ ডাকছে। সর্বশেষ টেক্সাস, উটাহ এবং ভার্জিনিয়ায় পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটেছে।
তবে নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীদের সাথে কর্তৃপক্ষের সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন সীমিত আকারে চালিয়ে যাবে বলে অঙ্গীকার করেছে। এদিকে, দেশটির জাতীয় রাজনীতিবিদরা কলেজগুলোকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। চলমান বিক্ষোভের মাঝে কিছু ক্যাম্পাসের বিক্ষোভে ইহুদিবিদ্বেষ দেখা গেছে বলে তারা অভিযোগ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ক্যাম্পাসের ইহুদি শিক্ষার্থীরা বিবিসিকে বলেছেন, কিছু ঘটনায় তারা অস্বস্তি বা ভীতি বোধ করছেন।
• বিক্ষোভ-প্রতিবাদে কাজ হচ্ছে?
ফিলিস্তিনপন্থি ক্যাম্পাস গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার উপায় হিসেবে বয়কট, বিনিয়োগ প্রত্যাহার, নিষেধাজ্ঞা (বিডিএস) আন্দোলনে সমর্থন জানানোর জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি বছরের পর বছর ধরে আহ্বান জানিয়ে আসছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত বিডিএস কাঠােমোর জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়নি। যদিও অতীতে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইসরায়েলের সাথে নির্দিষ্ট আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
ইসরায়েলি সংস্থা বা কোম্পানিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিনিয়োগ প্রত্যাহারের প্রভাব গাজা যুদ্ধে খুব বেশি পড়বে না বলে ধারণা করা হয়। তারপরও বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বলেছে, যুদ্ধ থেকে যারা লাভবান হচ্ছেন তাদের ওপর এটি প্রভাব ফেলবে। এর ফলে এটি তাদের আন্দোলনের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করবে।
• ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদের কথা কেন স্মরণ করছে শিক্ষার্থীরা?
কলাম্বিয়া ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার বিরুদ্ধে ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকের বিক্ষোভের কথা তুলে ধরেছে। সেই সময় পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের সহিংস সংঘর্ষ ও হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৭০ সালে ওহাইওতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গার্ডের গুলিতে চার শিক্ষার্থী নিহত হয়। তাদের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শিক্ষার্থী ধর্মঘট শুরু হয় এবং শত শত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়।
এসএস