নেসলের শিশুখাদ্য সেরেলাক এবং নিডোতে উচ্চ-মাত্রার চিনির উপস্থিতি পাওয়ার ঘটনায় বিশ্বের বৃহত্তম খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী সুইস এই বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে ভারত। বৃহস্পতিবার দেশটির সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে নেসলে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর তথ্য জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ভারতীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ নেসলে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। ভারতসহ নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে বিক্রি করা শিশুখাদ্য পণ্যে বাড়তি চিনি যুক্ত করার অভিযোগের বিষয়ে এই তদন্ত শুরু হয়েছে।

বুধবার সুইজারল্যান্ডের অনুসন্ধানবিষয়ক সংস্থা পাবলিক আই এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে নেসলের বিক্রি করা শিশুখাদ্যে বাড়তি চিনি যোগ করার তথ্য জানায়। যদিও যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড এবং অন্যান্য উন্নত দেশে নেসলের বিক্রি করা একই শিশুখাদ্যে কোনও ধরনের বাড়তি চিনি যুক্ত করা হয় না। শিশুদের খাবারে চিনি যুক্ত না করার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ রয়েছে। কারণ শিশুখাদ্যে চিনি যুক্ত করা হলে তা স্থূলতা এবং দীর্ঘস্থায়ী কয়েকটি রোগের কারণ হতে পারে।

পাবলিক আই ও ইন্টারন্যাশনাল বেবি ফুড অ্যাকশন নেটওয়ার্কের নেসলের শিশুখাদ্য সেরেলাক ও নিডো নিয়ে করা গবেষণায় মিলেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের যৌথ গবেষণায় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিক্রি করা নেসলের এই দুই শিশুখাদ্যে উচ্চ-মাত্রায় চিনি যুক্ত করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বেলজিয়ামের একটি ল্যাবরেটরিতে দীর্ঘদিন ধরে এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে পাবলিক আই।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে নেসলের ১৫টি সেরেলাক শিশুখাদ্য থেকে একটি শিশুকে একবার যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয় তাতে গড়ে প্রায় ৩ গ্রাম চিনি থাকে। একই পণ্য জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যে বিক্রি করা হচ্ছে বাড়তি চিনি ছাড়াই। অন্যদিকে, ইথিওপিয়া ও থাইল্যান্ডে এই চিনির পরিমাণ প্রায় ৬ গ্রাম।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি নেসলে ইন্ডিয়ার একজন মুখপাত্রের সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছে। ওই মুখপাত্র বলেছেন, তারা গত পাঁচ বছরে নেসলের শিশুখাদ্যে যোগ করা চিনির পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়েছে। এছাড়া আরও কমিয়ে আনার বিষয়ে তারা পণ্যগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা মান নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (এফএসএসএআই) বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তদন্তে নেসলে দোষী প্রমাণিত হলে ভারতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা সুইস এই ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে।

এদিকে, নেসলের শিশুখাদ্যে বাড়তি চিনি যোগ করার বিষয়ে তদন্ত শুরুর তথ্য জানাজানি হওয়ার পর ভারতে বহুজাতিক এই কোম্পানির শেয়ারের দামে পতন ঘটেছে। বৃহস্পতিবার ভারতের বাজারে নেসলের শেয়ারের দাম ৩ দশমিক ৩ শতাংশ কমে গেছে।

• বাংলাদেশেও নেসলের শিশুখাদ্যে বাড়তি চিনি

পাবলিক আই বলছে, নেসলে সুইজারল্যান্ডে বাজারজাত করা তাদের পণ্য সেরেলাকে বাড়তি কোনও চিনি ব্যবহার করে না। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে সেরেলাকে বাড়তি চিনি যুক্ত করে তারা।

মধ্য-আমেরিকার বেশিরভাগ দেশে ইনফ্লুয়েন্সারদের ব্যবহার করে নিডোর আক্রমণাত্মক প্রচার চালায় নেসলে। ওই অঞ্চলে এক বছর বা তার বেশি বয়সী বাচ্চাদের জন্য বাজারজাত করা ফর্মুলায় একটি শিশুকে সাধারণভাবে একবার যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয় তাতে চিনির পরিমাণ অনেক বেশি।

বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, সেনেগাল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও নিডো ব্যাপক জনপ্রিয়। এসব দেশেও এক থেকে তিন বছর বয়সী ছোট বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা নেসলের সব পণ্যে বাড়তি চিনি রয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে নেসলের ৯টি খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হয়। আর এসব পণ্যের প্রত্যেকটিতেই বাড়তি চিনি রয়েছে। নেসলের এসব পণ্য থেকে একটি শিশুকে একবার যে পরিমাণ খাবার পরিবেশন করা হয়, তাতে প্রায় ৩ দশমিক ৩ গ্রাম বাড়তি চিনি থাকে।

বিশ্বে শিশুখাদ্যের এক নম্বর ও সর্বাধিক বিক্রিত পণ্য নেসলের সেরেলাক। ইউরোমনিটরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে নেসলের এই একটি শিশুখাদ্যের বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাবলিক আই বলেছে, আমরা নেসলের প্রধান বাজার আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায় বিক্রি করা ১১৫টি পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। এর মধ্যে কমপক্ষে ১০৮টি (প্রায় ৯৪ শতাংশ) পণ্যে বাড়তি চিনি রয়েছে।

সুইস এই অলাভজনক সংস্থা বলেছে, আমরা এসব পণ্যের মধ্যে ৬৭টিতে বাড়তি চিনির পরিমাণ নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের বিশ্লেষণে একবার পরিবেশন করা খাবারে প্রায় ৪ গ্রাম বাড়তি চিনির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে নেসলের খাদ্যপণ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ চিনির উপস্থিতি পাওয়া গেছে ফিলিপাইনে। দেশটিতে একজন শিশুকে সাধারণভাবে একবার যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয়, তাতে গড়ে প্রায় ৭ দশমিক ৩ গ্রাম বাড়তি চিনি থাকে।

জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারসরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্যের অধ্যাপক ও শিশু বিশেষজ্ঞ কারেন হফম্যান বলেন, ‌‘‘আমি বুঝতে পারছি না কেন দক্ষিণ আফ্রিকায় বিক্রি করা পণ্য উচ্চ-আয়ের দেশগুলোতে বিক্রি হওয়া পণ্যের তুলনায় আলাদা হতে হবে।’’ তিনি বলেন, এটা ঔপনিবেশের একটি রূপ এবং এটা মেনে নেওয়া উচিত নয়। হফম্যান জোর দিয়ে বলেন, শিশুখাদ্যে বাড়তি চিনি যোগ করার বৈধ কোনও কারণ নেই।

এসএস