আমেঠিতে কংগ্রেসের অফিস আকারে যথেষ্ট বড়। কিন্তু তার সামনে এসে থমকে দাঁড়াতে হলো। অফিসে ঢোকার মূল গেট তালাবন্ধ। রোববার, আম্বেডকর জয়ন্তী সবই ঠিক আছে, তা বলে নির্বাচন যেখানে মাসখানেক দূরে (আমেঠিতে ভোট ২০ মে), সেখানে এই সময় প্রধান অফিস তালাবন্ধ থাকে নাকি!

অবশ্য অবাক হওয়ারও কিছু নেই। নেহরু-গান্ধী পরিবারের একসময়ের এই শক্ত ঘাঁটিতে এখনো পর্যন্ত প্রার্থীর নামই জানাতে পারেনি কংগ্রেস। পাশের কেন্দ্র রায়বেরিলিতেও নয়।

২০১৯ সালে এখানেই রাহুল গান্ধীকে হারিয়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন স্মৃতি ইরানি। রাহুল জিতেছিলেন কেরালার ওয়ানাড়ে। এবারও সেখানে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ঘোষণা করেছেন, ওয়ানাড় তার পরিবারের মতো। আর আমেঠি-জুড়ে সেই কথাটা ভালোভাবেই প্রচার করেছে বিজেপি।

কংগ্রেসের অফিসের লাগোয়া গলিতে দাঁড়িয়ে এক মধ্যবয়স্ক বলছিলেন, ‘এমন নয় যে কংগ্রেস অফিস খোলে না। খোলে, আবার মাঝেমধ্যে বন্ধও থাকে। একজন কেয়ারটেকার থাকেন। ছুটির দিন বলে তিনিও নেই।’

আগে এই অফিসই রমরম করত। কর্মীরা আসছেন-যাচ্ছেন। বৈঠক হচ্ছে। প্রচার-সামগ্রী বিলি করা হচ্ছে। যেরকম ব্যস্ততা ভোটের আগে অফিসগুলোতে থাকে আর কী।

অবশ্য কংগ্রেস এই নেতা-কর্মীদের দোষ দিয়েই বা কী হবে? রাহুল নিজেই বা হারের পর কতবার আমেঠি এসেছেন, তা এখানকার মানুষের কণ্ঠস্থ। আমেঠির হারের ধাক্কায় তিনি গত পাঁচ বছরে  তিনি বারবার ওয়ানাড় গেছেন, কিন্তু আমেঠিতে এসেছেন ওই হাতে গুনে কয়েকবার। পরিচর্যা না করলে যে ফুলের বাগান যেমন শুকিয়ে যায়, নির্বাচনকেন্দ্রও তেমনই মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

অথচ এই আমেঠিতে সঞ্জয় গান্ধী জিতেছেন, রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধীর পর রাহুল গান্ধীও একাধিকবার জিতেছেন। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের প্রভাব কমেছে। কিন্তু মরুদ্যানের মতো নেহরু-গান্ধী পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে দুই প্রতিবেশী এলাকা আমেঠি ও রায়বেরিলি।

অযোধ্যা থেকে আমেঠি আসার পথে গ্রামের ধারে চায়ের দোকানে বসেছিলেন জনা দশেক মানুষ। এপ্রিলের মাঝামাঝি চড়া রোদ। রোববার ছুটির দিনের দুপুরে আড্ডা দিচ্ছিলেন তারা। পশ্চিমবঙ্গের মতো উত্তরপ্রদেশেও চায়ের দোকানের আড্ডার একটা রীতি আছে।

সেখানে বসে বীজেন্দ্র পাণ্ডে বলছিলেন, ‘দিন বদলে গেছে। এখন আর দূরে গাড়ি নিয়ে নেতা যাবেন, হাত নাড়বেন, আমরা তাকে ভোট দেব, এটা হয় না। ভোটের পর নিয়মিত আসতে হয়। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়।’

বীজেন্দ্রর দাবি, তারা সবাই আগে কংগ্রেসকে ভোট দিতেন। এখন দেন স্মৃতিকে। পাশ থেকে একজন গর্বের সঙ্গে জানালেন, ‘জানেন তো, স্মৃতি তো এখানে বাড়ি কিনে ফেলেছেন।’ ভোটের বাজারে এই ছোটখাট জিনিসই বড় হয়ে ওঠে।

গৌরীগঞ্জে দলের অফিসের আধ কিলোমিটার দূরেই স্মৃতি ইরানি বাড়ি কিনেছেন। আমেঠি এলে সেখানেই থাকছেন তিনি। আর এই খবর ইতোমধ্যেই মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বিজেপির নেতা-কর্মীরা। স্মৃতি ইতোমধ্যে একাধিকবার আমেঠি এসে দলের সবস্তরের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

পান্না-প্রমুখ মানে ভোটার তালিকায় একটা পাতার দায়িত্বে থাকা বিজেপি কর্মী, আধা-পান্না প্রমুখ বা অর্ধেক পাতার দায়িত্বে থাকা কর্মী, বুথের দায়িত্বে থাকা কর্মী, প্রচারের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক সেরে ফেলেছেন। দলের প্রচার শুরু হয়ে গেছে। আর দিন দুয়েকের মধ্যে স্মৃতিও নেমে যাবেন পুরোদস্তুর প্রচারে।

গৌরীগঞ্জের বিজেপি অফিসে বসে আমেঠির বিজেপি সভাপতি রমাপ্রসাদ মিশ্র বলছিলেন, ‘কংগ্রেস আগে প্রার্থীর নাম জানাবে, তিনি প্রস্তুতি নেবেন, খুব বেশি হলে দিন ১৫ ঠিকভাবে প্রচারের সময় পাবেন। আর বিজেপির প্রস্তুতি অনেকদিন ধরে চলছে। আর এই যে স্মৃতি বাড়ি কিনেছেন, তা মানুষ খুবই ভালোভাবে নিচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী যেই হোক না কেন আমরা এখন শুধু জয়ের ব্যবধান বাড়ানোর কথা ভাবছি।’

অযোধ্যা থেকে আমেঠির দূরত্ব মাত্র ১০২ কিলোমিটার। গাড়িতে সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েকের মতো। ঝকঝকে রাস্তা। আর অযোধ্যায় রামমন্দির ও নতুন রাস্তাঘাটই ভারতজুড়ে বিজেপির প্রচারের হাতিয়ার।

রমাপ্রসাদ বলছিলেন, ‘রামমন্দিরের উদ্বোধন হওয়ার পর আমেঠি থেকে প্রতিদিন পাঁচটি বাসভর্তি মানুষ অযোধ্যায় গিয়ে রামমন্দির দেখে এসেছেন। উত্তরপ্রদেশে একটু ঘুরলেই বোঝা যায়, রামমন্দিরের প্রভাব কতখানি। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাস্তাঘাট, বিনা পয়সায় রেশন, কৃষকদের বছরে ছয় হাজার টাকা দেওয়া এবং পাঁচ লাখের স্বাস্থ্যবিমা। এছাড়া গরিব মানুষের ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এ সবের প্রভাব ভোটে খুব বড় আকারে পড়বে বলে আমরা নিশ্চিত।’

তবে দীর্ঘদিন ধরে যে কেন্দ্র সঞ্জয়, রাজীব, সোনিয়া, রাহুল গান্ধীদের জিতিয়ে এনেছে, সেখানে কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন একেবারে নেই এমন ভাবাটা ভুল হবে। ওই গ্রামের চায়ের দোকানের আড্ডায় আবার ফিরে যাই। সেখানেই মানুষজন বলছিলেন, এমন নয় যে, কংগ্রেস বা রাহুলের প্রতি সমর্থন নেই। এখনও আছে। কিন্তু রাহুলদের ডোবাচ্ছেন স্থানীয় কংগ্রেসিরা।

রাহুলরা কাজ করতে চাইলেও তার ফল মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। চলে গেছে কংগ্রেস কর্মীদের কাছে। তবে কিছু মানুষ এখনো প্রত্যাশা করছেন, রাহুলই আমেঠি থেকে দাঁড়াবেন। কংগ্রেস অফিসের বাইরে পানের দোকানদার চৌরাশিয়ার আশা, ‘শুনছি তো রাহুল দুটো কেন্দ্র থেকে দাঁড়াবেন। ওয়ানাড় ও আমেঠি। আমরা চাই রাহুল এখান থেকে আবার লড়ুন। তাহলে তিনি জিতবেন।’

কিন্তু কীভাবে? তার জবাব, ‘গতবার হয়নি বলে কি এবার হবে না। মনে রাখবেন, আমেঠি কেন্দ্রে পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে দুইটি কেন্দ্রে সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক আছেন। তিনটিতে বিজেপি। সমাজবাদীর সঙ্গে কংগ্রেসের জোট হয়েছে। রাহুলের একটা প্রভাব আছে। ফলে লড়াইটা সমানে সমানে হবে।’

কিন্তু ওই যে রাহুল ওয়ানাড়কেই তার পরিবার বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন। তারপর তিনি কি আর আমেঠিমুখি হবেন? এখনো পর্যন্ত আমেঠি, রায়বেরিলির প্রার্থী দেওয়া নিয়ে কংগ্রেস নেতারা দিল্লিতে বলেছেন, সময় হলেই জানানো হবে। কিন্তু সময় যে বয়ে যায়। সাসপেন্স বজায় রেখে কী লাভ হচ্ছে? রায়বেরিলিতে প্রিয়ংকা ও আমেঠিতে রাহুল না দাঁড়ালে এই দুই কেন্দ্রে কংগ্রেসের যে প্রভাব আছে, তাও ধীরে ধীরে অস্তাচলে চলে যাওয়ার ষোলো আনা সম্ভাবনা আছে।

আমেঠি থেকে জেতার পর এখানে শিল্পতালুক করেছিলেন। একের পর এক কারখানা তৈরি হয়েছিল। এখন প্রায় সবই বন্ধ। তারপরেও রাহুল দীর্ঘদিন এখান থেকে জিতেছেন। গতবারই হেরেছেন। উত্তরপ্রদেশের অন্য জায়গা থেকে কংগ্রেস ধীরে ধীরে প্রায় মুছে যাচ্ছে। এবার কি আমেঠি, রায়বেরিলি থেকেও ক্রমশ হারিয়ে যাবে তারা?

টিএম