ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের স্পিডবোড যখন অবস্থান নিতে শুরু করে তখন বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের ক্যাপ্টেন সংকেত পাঠান এবং সাহায্য চেয়ে জরুরি হটলাইনে কল করেন।

তবে সময় অনুযায়ী সেখানে কেউ পৌঁছায়নি। সোমালিয়ার জলদস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহতে ওঠে পড়ে। তারা প্রথমে একটি সতর্কতামূলক গুলি ছোড়ে। এরপর জাহাজের ক্যাপ্টেন ও সহকারীকে জিম্মি করে। এমভি আব্দুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খান এক অডিও বার্তায় জাহাজটির মালিকের কাছে এ তথ্য জানান।

জলদস্যুরা মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার আগে আতিক উল্লাহ খান আরেকটি বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি লিখেছেন “আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হননি।” বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে ক্যাপ্টেনের সেই বার্তাগুলো দেখিয়েছে জাহাজের মালিকানাধীন কোম্পানি।

জলদস্যুরা এমভি আব্দুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার এক সপ্তাহ পর এটি সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে নোঙর করা হয়। একটা সময় বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনী ভেবেছিল তারা ভারত মহাসাগরে জলদস্যুতাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

জলদস্যুদের হামলার কারণে শিপিং কোম্পানিগুলোর ঝুঁকি এবং খরচ বাড়ছে। জলদস্যুদের মোকাবিলা করার পাশাপাশি একই সময়ে লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের চালানো ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে তাদের। হুথিদের হামলায় যখন এসব কোম্পানির গায়ে ‘ঘা’ তৈরি হয়েছে। তখন সোমালি দস্যুদের উত্থান যেন সেই ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দেওয়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত অন্তত ২০টি জাহাজে ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালিয়েছে দস্যুরা। জাহাজ শিল্পের পাঁচজন প্রতিনিধি রয়টার্সকে জানিয়েছেন, এই ছিনতাই চেষ্টার কারণে সশস্ত্র গার্ডের খরচ বেড়ে গেছে। সঙ্গে বেড়েছে ইন্সুরেন্সের দামও।

সোমালিয়ার দুইজন গ্যাং সদস্য রয়টার্সকে জানিয়েছেন, লোহিত সাগরে হুথি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে তাদের জাহাজ ছিনতাইয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় জলদস্যুতা সুপ্ত অবস্থায় ছিল।

জলদস্যুদের পেছনে বিনিয়োগ করা ঈসমাইল ওরফে ইসা নামের এক ব্যক্তি রয়টার্সকে বলেছেন, “সোমালিয়া উপকূলে যেসব আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী ছিল তারা তাদের তৎপরতা কমিয়ে দিয়েছে। তারা (জলদস্যুরা) এই সুযোগ নিয়েছে।”

ঈসমাইল ওরফে ইসা টেলিফোনের মাধ্যমে সোমালিয়ার আধা স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল পুন্টল্যান্ড থেকে ফোনের মাধ্যমে এসব তথ্য জানান। এই পুন্টল্যান্ডে গত ডিসেম্বরে ছিনতাই করা জাহাজ এমভি রুয়েনকে কয়েক সপ্তাহ রাখা হয়েছিল।

২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সোমালি উপকূলে দস্যুতের যে তৎপরতা ছিল সেই রকম পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। তবে এ শিল্প সংশ্লিষ্টদের ভয় পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে।

গত মাসে সোমালি প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মাহমুদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এখনই যদি আমরা দস্যুতা বন্ধ করতে না পারি। এটি আবারও পূর্বের রূপ ধারণ করতে পারে।”

গত সপ্তাহে ভারতীয় নৌবাহিনী এমভি রুয়েনে হামলা চালিয়ে দস্যুদের কাছ থেকে জাহাজটিকে মুক্ত করে। জাহাজটি মাল্টার পতাকা নিয়ে চলছিল। সোমালিয়ার উপকূল থেকে বের হওয়ার পরই এতে হামলা চালাতে সমর্থ হয় ভারতীয় নৌ সেনারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দস্যুতাবিরোধী মিশন ইউনেভফোর আটলান্টা জানিয়েছে, দস্যুরা হয়ত বাংলাদেশি জাহাজটি ছিনতাইয়ে এমভি রুয়েনকে ব্যবহার করেছে।

আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্সের অপরাধ বিরোধী সংস্থার উপপরিচালক সায়রুস মোডি জানিয়েছেন, ভারতীয় নৌবাহিনীর হস্তক্ষেপ, যেটি লোহিত সাগরের আশপাশে অন্তত ১২টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে, দস্যুতা কমাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

তিনি বলেছেন, “ভারতীয় নৌবাহিনীর হস্তক্ষেপ দেখাচ্ছে ঝুঁকি/পুরস্কার দুটিই দস্যুদের বিরুদ্ধে রয়েছে। আমি আশা করি বিষয়টি জাহাজ ছিনতাইয়ের আগে তাদের কয়েকবার ভাবাবে।”

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে রয়টার্সকে বলেছেন, তারা এমভি আব্দুল্লাহকে মুক্ত করতে কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ চান না। কারণ জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূলে আছে। সেখানে দস্যুদের অবস্থান বেশ দৃঢ়।

ক্রমবর্ধমান ব্যয়

সোমালিয়ার জলপথে রয়েছে বিশ্বের ব্যস্ততম শিপিং রুট। প্রতি বছর ফার্নিচার থেকে শুরু করে পোশাক, পোশাক থেকে শস্য এবং জ্বালানিবাহী ২০ হাজার জাহাজ এডেন উপসাগর থেকে লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খাল দিয়ে চলাচল করে থাকে। যা ইউরোপ থেকে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম দূরত্বের সামুদ্রিক পথ।

দস্যুরা সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল ২০১১ সালে। ওই বছর সোমালি জলদস্যুরা জাহাজে ২৩৭টি হামলা চালায় এবং কয়েকশ নাবিককে জিম্মি করে। ওই বছর এই দস্যুদের কারণে ৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষয়ক্ষতি হয়। যারমধ্যে ছিল মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ।

আগের তুলনায় দস্যুদের অবস্থান এখন অনেকটা দুর্বল। গত নভেম্বর থেকে তারা দুটি বড় জাহাজ এবং ১২টি মাছ ধরার ছোট জাহাজ জিম্মি করতে সমর্থ হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনেভফোর।

তবে সংস্থাটি জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে তারা এডেন উপসাগর এবং সোমালি বেসিনে দস্যুদের অন্তত পাঁচটি গ্রুপকে শনাক্ত করেছে। সংস্থাটি সতর্কতা দিয়ে বলেছে, বর্ষা মৌসুম শেষ হলে দস্যুরা আরও দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে যেতে পারে।

দস্যুদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইন্সুরেন্সের ব্যয় অনেক বেড়েছে। এছাড়া বেড়েছে সশস্ত্র গার্ডদের ব্যয়ও। গার্ডদের একটি দলকে আগে তিনদিনের জন্য ভাড়া করতে যে অর্থ খরচ করতে হতো সেটি ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী নয়

প্রায় এক যুগ আগে যখন দস্যুদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল তখন ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন জোট ওই অঞ্চলে একাধিক যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। তাদের প্রচেষ্টার কারণে দস্যুরা নিজেদের গুটিতে নিতে বাধ্য হয়। তবে এরপর যেসব দেশ দস্যু দমনে এসেছিল তারা সেখান থেকে চলে গেছে। ফলে বর্তমানে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন শক্তিশালী অবস্থায় নেই।

সূত্র: রয়টার্স

এমটিআই