রাশিয়ার প্রধান বিরোধী নেতা অ্যালেক্সেই নাভালনির মৃত্যুর ধাক্কা সম্পূর্ণ কেটে যাওয়ার আগেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম এই দেশটিতে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ১৫ থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত দেশজুড়ে এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবারের নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচনে জয়ী হলে পঞ্চমবারের মতো প্রেসিডেন্ট হবেন তিনি এবং সেক্ষেত্রে তার ক্ষমতার মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়বে।

সেই সঙ্গে রাশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রেসিডেন্ট পদে থাকার রেকর্ডটিও তার হয়ে যাবে। বর্তমানে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে থাকার রেকর্ডের মালিক জোসেফ স্তালিন এবং লিওনিদ ব্রেজনেভ। সাবেক সোভিয়েত আমলে দু’জনেই ২৪ বছর করে ক্ষমতায় ছিলেন। ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির প্রার্থী ৭১ বছর বয়সী পুতিন যদি ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন, তাহলে তার ক্ষমতার মোট মেয়াদকাল পৌঁছাবে ৩০ বছরে।

রুশ সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে রয়টার্স জানিয়েছে, এবারের নির্বাচনে পুতিনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বেশ কয়েজন প্রার্থী। তাদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন রুশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নিকোলাই খারিতোনভ, ন্যাশনালিস্ট লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা লিওনিদ স্লাতস্কি এবং নিউ পিপল পার্টির ভ্লাদিস্লাভ দাভানকোভ।  

তবে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর অভিযানের বিরোধিতা করার কারণে জনপ্রিয় দুই রুশ প্রার্থীকে এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এরা হলেন বরিস নাদেজদিন এবং ইয়েকাতেরিনা দান্তসোভা।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিপির লেফটেন্যান্ট কর্নেল পুতিন প্রথম রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন ১৯৯৯ সালে। তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিন ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুতিনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেছিলেন।

পরে ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতেন পুতিন। ২০০৪ সালের নির্বাচনে ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ফের প্রেসিডেন্ট হন।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাশিয়ার সংবিধানেও কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে থাকার অনুমতি ছিল না। তাই ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিজের বিশ্বস্ত অনুসারী দিমিত্রি মেদভেদেভকে তিনি প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হন। সেই নির্বাচনে মেদভেদেভ এবং পুতিন— উভয়ই জয়ী হয়েছিলেন।

২০১২ সালে ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হন পুতিন এবং ৬২ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে সেই নির্বাচনে জেতেন। সেবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে সংবিধানে পরিবর্তন আনেন তিনি। প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল ৪ বছর থেকে ৬ বছরে উন্নীত করেন এবং দুই বারের বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীতা না করার যে বাধ্যবাধকতা ছিল— তা বাতিল করেন।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন পুতিন। সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না তিনি। তবে তার দল ইউনাইটড রাশিয়া পার্টির নেতারা জানিয়েছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তার সেই সিদ্ধান্তে বদল এসেছে।

নির্বাচন কমিশনে তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড এবং ইউক্রেনের রুশ ভূখণ্ড দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, ঝাপোরিজ্জিয়া, খেরসন এবং ক্রিমিয়া মিলে এবারের নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ২৩ লাখ। সেই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী রুশ নাগরিকদের মধ্যে ভোটার রয়েছেন ১৯ লাখ। এছাড়া কাজাখস্তানের বাইকোনুর শহরে রাশিয়ার যে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র এবং সেই কেন্দ্রকে ঘিরে যে রুশ উপশহর গড়ে উঠেছে, সেখানে ভোটার রয়েছেন প্রায় ১২ হাজার।  

নির্বাচন কমিশন আশা করছে, এবারের নির্বাচনে ৭০ শতাংশেরও বেশি ভোটার ভোট দেবেন।

পুতিন রাষ্ট্রনায়ক না স্বৈরাচার

পশ্চিমা বিশ্ব যদিও ভ্লাদিমির পুতিনকে একজন অপরাধী, খুনী এবং স্বৈরাচার হিসেবে বরাবরই চিহ্নিত করে আসছে, তবে রাশিয়ার অভ্যন্তরে এই চিত্র অনেকাংশে ভিন্ন। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, রুশ জনগণের কাছে পুতিনের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্য ৮৫ শতাংশ বা তারও বেশি।

সোমবার এক বার্তায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন জানিয়েছে, রাশিয়ার জনগণের এই বিপুল সমর্থনকে পুতিন সবসময় উপভোগ করেন এবং তিনি খুবই খুশি যে রুশ জনগণ পুতিনকে সমর্থনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে ‘গণতন্ত্র বিষয়ক লেকচার’ শুনতে আগ্রহী নয়।

রাশিয়ার রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক বিপর্যয় শুরু হয়েছিল রাশিয়ায়, নিজের দীর্ঘ শাসনামলে সেই বিপর্যয় ঠেকানোর পাশাপাশি মস্কোকে বিশ্ববাসীর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছেন পুতিন ও তার অনুসারীরা। এমনকি সোভিয়েত ও তার পূর্ববর্তী আমালে বিশ্বে রাশিয়ার যে গৌরবোজ্জল ভাবমূর্তি ছিল, তা ও অনেকাংশে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তার মূল কারণ এটিই।

তবে পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অধিকাংশের বক্তব্য, রাশিয়ায় পুতিনের অবস্থান অনেকটা ‘মাফিয়া গডফাদারের’ মতো এবং কোনো সমালোচক বা বিরোধী পুতিন ও তার নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের সরাসরি বিরোধিতায় নামলে কোনো রাজনৈতিক নেতার পক্ষে রাশিয়ায় থাকা অসম্ভব।

ভোট বয়কট, বিক্ষোভের ডাক

রাশিয়ার প্রধান বিরোধী নেতা এবং পুতিনের সবচেয়ে বড় সমালোচক অ্যালেক্সেই নাভালনি গত ১৬ অক্টোবর কারাগারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। পুতিনের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন এই ঘটনাকে মৃত্যু বলে ঘোষণা করলেও নাভালনির সমর্থকদের অভিযোগ— কারাগারে নির্যাতনে নিহত হয়েছেন নাভালনি।

নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনি ভোট বয়কট এবং ভোটের দিন অর্থাৎ ১৫ থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত রাশিয়াজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। মঙ্গলবার এক বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘অ্যালেক্সেই নাভালনির মৃত্যুর পর রাশিয়া ও বিশ্বের জনগণ যেভাবে সাড়া দিয়েছেন, তাতে এটি প্রমাণিত যে বর্তমান রুশ প্রশাসনের সমালোচনা করে তিনি যেসব কথা বলতেন— সেগুলো ভিত্তিহীন ছিল না।’

‘আমরা ভোট বয়কট এবং প্রতিবাদ বিক্ষোভের মাধ্যমে রুশ প্রশাসনকে এই বার্তা দিতে চাই যে আমরা যুদ্ধের বিপক্ষে, দুর্নীতির বিপক্ষে, আইনের শাসনের অনুপস্থিতির বিপক্ষে।’

সূত্র : রয়টার্স

এসএমডব্লিউ