বলছেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ
খাবার ও ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জার পাশাপাশি হামলা হচ্ছে হাসপাতালেও। এতে করে গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই ভেঙে পড়েছে।
এরসঙ্গে অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডটিতে দেখা দিয়েছে তীব্র মানবিক সংকট। এমন অবস্থায় খাবার ও ক্ষুধাকে ইসরায়েল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছেন জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ।
বিজ্ঞাপন
এমনকি ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখার ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসাবেও আখ্যায়িত করেছেন তিনি। শুক্রবার (৮ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার খাদ্যের অধিকারের বিষয়ে জাতিসংঘের একজন বিশেষ প্রতিনিধি গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণকে অনাহারে রাখতে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসরায়েল খাদ্য এবং ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে।
ইউএন হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের ৫৫তম অধিবেশনে যোগ দিতে জেনেভায় অবস্থান করার সময় মাইকেল ফাখরি গাজায় খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলের হামলা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন।
গত বছরের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজার ফিলিন্তিনিরা অভূতপূর্ব অনাহারের সম্মুখীন হয়েছে উল্লেখ করে ফাখরি বলেছেন: ‘যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমরা দেখেছি মানুষ অভূতপূর্ব উপায়ে ক্ষুধার্ত থাকছে। এতো তাড়াতাড়ি ক্ষুধার্ত হতে আমরা কোনও সম্প্রদায়কে দেখিনি। এখন আমরা যা দেখছি তা হলো দুর্ভিক্ষ। শিশুরা অপুষ্টি এবং পানিশূন্যতায় মারা যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, আধুনিক ইতিহাসে কোনও সংঘাতে শিশুদের এতো দ্রুত অপুষ্টির শিকার হতে আমরা দেখিনি।
অপুষ্টির শিকার শিশুদের বিকাশে সমস্যা হবে জানিয়ে ফাখরি আরও বলেন: ‘আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম যে, তারা হয়তো স্টান্টিংয়ে (খুবই অল্প পরিমাণে পুষ্টি, বারবার সংক্রমণ এবং অপর্যাপ্ত মনোসামাজিক উদ্দীপনা) আক্রান্ত হতে পারে। যার অর্থ- তারা স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী ভাবে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা শিশুদের অপুষ্টি এবং ডিহাইড্রেশনে মারা যেতে দেখছি, এটি ভয়াবহ অবস্থা।’
এই মুহূর্তে মৃত্যুর গতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে ফাখরি বলেন: ‘আমি এর চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি কল্পনা করতে পারি না।’
বিমান থেকে সহায়তা ফেলা ব্যয়বহুল, কিন্তু কার্যকর নয়
গাজায় মানবিক সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে খাদ্যসহ বিভিন্ন সহায়তা সরঞ্জাম নিচে ফেলছে। এ সম্পর্কে ফাখরি বলেছেন: ‘সহায়তা সরঞ্জাম এভাবে নিচে ফেলা খুব ব্যয়বহুল। কিন্তু এর বিপরীতে এগুলো খুব একটা কার্যকর নয়। প্রকৃতপক্ষে, কখনও কখনও এভাবে সহায়তা দেওয়া প্রচুর বিশৃঙ্খলা এবং সমস্যার কারণ হতে পারে। কারণ খাবার বিতরণের কোনও পদ্ধতিগত উপায় ছাড়াই নিচে ফেলা এসব খাবার সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ধরনের ব্যয়বহুল পন্থায় সময় এবং অর্থ ব্যয় করার পরিবর্তে আমি মনে করি যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশগুলোর অবিলম্বে ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত, যাতে মানবিক সাহায্য নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয় এবং একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতিও নিশ্চিত হয়।’
উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন আন্তঃসীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন
এছাড়া ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
মূলত ইসরায়েলি আক্রমণ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সংকটের মধ্যে গাজার সকলেই এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন।
এছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ কোনও ধরনের আশ্রয় ছাড়াই বসবাস করছে এবং প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম ত্রাণবাহী ট্রাক এই অঞ্চলে প্রবেশ করছে।
ইসরায়েল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক অন্তর্বর্তী রায়ে এই আদালত তেল আবিবকে গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে এবং গাজার বেসামরিক নাগরিকদের মানবিক সহায়তা প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়।
টিএম