ফাইল ছবি

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্ভবত আজই শেষ দিন। মঙ্গলবার তিনি বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন। বিচারপতি হিসাবে আরও পাঁচ মাস কাজ করতে পারতেন তিনি।

তার আগেই তিনি অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘রাজনীতিতে না প্রবেশ করলে প্রচুর সাধারণ মানুষ আছেন যাদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না।’

বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের জানিয়েছেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, আসুন লড়াই করুন। শাসক দলকে ধন্যবাদ জানাব, আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করার জন্য। আমি আসছি।’

তার বক্তব্য, ‘ইতিহাসে মৌর্য সাম্রাজ্যের কথা পড়েছি। এখন চোখের সামনে চৌর্য সাম্রাজ্য দেখছি।’

অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আমি খুব তাড়াতাড়ি বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে চলেছি। মঙ্গলবার ইস্তফা দেব। মঙ্গলবার দেড়টায় আমি সব প্রশ্নের উত্তর দেব।’

কী বললেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

তিনি জানিয়েছেন, ‘আদালতে যে সময়টা কাজ করি, তা এখন শেষ হয়েছে বলে অন্তরাত্মা বলছে। আদালতের বাইরে প্রচুর সাধারণ মানুষ আছেন। তাদের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। ছয় বছর ধরে বিচারপতি হিসাবে কাজ করলাম। সেখানে নতুন করে কিছু করার নেই। বাকি সময়টা আমি অন্য কাজে কাটাব।’

তিনি বলেছেন, ‘বৃহত্তর ক্ষেত্রে যেতে হচ্ছে, আমি তার জন্য ক্ষমতাসীন দলকে অভিনন্দন জানাব। যখনই আমি ন্যায়বিচার করতে গেছি, তাদের বিভিন্ন মুখপাত্র আদালত ও বিচারপতিকে নিয়ে নানান ধরনের মন্তব্য করেছেন, রঙ্গব্যঙ্গ করেছেন, বলা হয়েছে, মাঠে আসুন, এসে লড়াই করুন। ভেবে দেখলাম, তারা যখন এতো করে ডেকেছেন, এতো অপমানজনক কথা বলেছেন, তখন তাদের ইচ্ছে পূর্ণ হওয়া দরকার।’

তিনি জানিয়েছেন, ‘রাজনৈতিক দলে না গেলে আদালতের ক্ষেত্রের বাইরের মানুষদের কাছে পৌছানো যাচ্ছে না। আমি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারি। টিকিট দেওয়া না দেওয়া সেই রাজনৈতিক দলের ব্যাপার। অনেক রাজনৈতিক দল আছে। বাম, কংগ্রেস, বিজেপি, ছোট দল, তারা যদি মনে করে টিকিট দেবেন, তখন ভেবে দেখব প্রার্থিপদ নেব কিনা। এখনও বহু দপ্তরে দুর্নীতি উদ্ঘাটন হয়নি। সেই দুর্নীতি সামনে এলে বোঝা যাবে, কোন রাজ্যে বাস করছি।’

তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি তৃণমূলে যোগ দিচ্ছি না। তার মতে, পশ্চিমবঙ্গে অন্ধকার নেমে আসছে। সব ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ নিচে চলে যাচ্ছে। তা বাঙালি হিসাবে, পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হিসাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।’

অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কি বিজেপিতে?

বিচারপতির পদ ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও, রাজনীতির আঙিনায় আসার কথা বললেও, কোন দলে যোগ দেবেন তা জানাননি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তবে রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘সৎ মানুষদের এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা লড়াই করতে চান, তাদের বিজেপিতে যোগ দেওয়াই স্বাভাবিক।’

বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী আগেই বলে রেখেছিলেন, ৭ মার্চ বড় ঘটনা ঘটবে। তিনি জানিয়েছেন, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ইস্তফা দেওয়ার পরই তিনি প্রতিক্রিয়া জানাবেন।

তবে বিজেপি সূত্র বলছে, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তমলুক থেকে বিজেপির প্রার্থী হতে পারেন। এই কেন্দ্র থেকে গতবার নির্বাচিত হয়েছেন শুভেন্দুর ভাই দিব্য়েন্দু। তমলুককে অধিকারী পরিবারের খাস কেন্দ্র বলে অভিহিত করা হয়। ফলে তমলুকে দাঁড়ালে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায়কে জেতানোর দায়িত্ব শুভেন্দুই নেবেন।

এছাড়া অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে একের পর এক আলোড়ন ফেলে দেওয়া রায় দিয়েছিলেন, তাদের একটা বড় অংশই পূর্ব মেদিনীপুরের। ফলে এখানে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের একটা প্রভাব থাকবে। বিজেপিতে যোগ দিলে তারা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটা নিরাপদ আসন থেকে জিতিয়ে আনতে চাইবেন।

তবে তিনি এই লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়াবেন, কোন দলের হয়ে দাঁড়াবেন, নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে দাঁড়াবেন, তা তিনি মঙ্গলবার বা তারপর স্পষ্ট করবেন। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, যে চাকরিপ্রার্থীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তারা নিশ্চয়ই অন্য বিচারপতিদের কাছ থেকে সাহায্য পাবেন।

সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া

সুপ্রিম কোর্টের অশোক গঙ্গোপাধ্য়ায় বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ইস্তফা দিতে পারেন। উনি সংবিধান অনুযায়ী ইস্তফা দিচ্ছেন। এটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’

তৃণমূলের মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘তিনি যে একটি রাজনৈতিক বোড়ে এটা বহুদিন আগে বলেছি। এখন তার যাবতীয় পর্যবেক্ষণ ভোঁতা হয়ে গেল।’

সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ‘প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার লড়াই অনেককে খুশি করেছিল।’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী দাবি করেছেন, ‘উনি ব্যতিক্রমী চরিত্র। কিছুদিন ধরে বাংলার মানুষের আলোচনায় ছিলেন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যোদ্ধা। তিনি কংগ্রেসে এলে তাকে স্বাগত জানাব। অভিজিৎ গঙ্গেোপাধ্যায় লড়াকু, প্রতিবাদী চরিত্র। তিনি বিজেপিতে গেলে তাকে সমর্থন করতে পারব না।’

অধীর বলেছেন, ‘কংগ্রেসে এলে তাকে যথাযথ সম্মান দেব।’

প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেছেন, ‘অকাল অবসর নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিতে যাচ্ছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এখন তিনি সাম্প্রতিককালে যে সব রায় দিয়েছেন, যে সব পর্যবেক্ষণ করেছেন, তা প্রশ্নের মুখে পড়তেই পারে।’

শুভাশিস বলেছেন, ‘বিচারপতি হিসাবে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অনেক বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। কথাগুলো অনেক সময় অ্যাক্টিভিস্টের মতো লেগেছে।’

বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ‘ভারতে ১৯৬৭ সালে সুব্বা রাও বিচারপতির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নেমেছিলেন। কৃষ্ণ আইয়ার রাজনীতি থেকে বিচারপতি হয়েছিলেন। তবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এটা বিরলতম ঘটনা।’

বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে, ‘বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যে রায় দিয়েছেন, তা ডিভিশন বেঞ্চে এবং পরে সুপ্রিম কোর্টে গেছে। তারপর তা রূপায়িত হয়েছে। তার অধিকাংশ রায় সুপ্রিম কোর্টে গৃহীত হয়েছে। এখন যেসব মানুষ বিচারপতিদের শুধুমাত্র বিচারের চেয়ারে দেখতে চান, তারা আহত হবেন। যারা তাকে সংস্কারের অঙ্গ হিসাবে দেখতে চান, তারা খুশি হবেন।’

টিএম