দক্ষিণ গাজা উপত্যকায় রাফাহতে হামলার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির কাছে বসে আছে এক ফিলিস্তিনি পরিবার। ছবিটি ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর তোলা

টানা প্রায় পাঁচ মাস ধরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরায়েল। অবিরাম এই হামলায় ভূখণ্ডটিতে নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ৩০ হাজারে। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

অন্যদিকে দুই বছর পেরিয়ে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ গড়িয়েছে তৃতীয় বছরে। দীর্ঘ এই সময়ে হামলা-পাল্টা হামলায় হয়েছে হাজারও মানুষের প্রাণহানি। তবে নতুন এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে নিহত নারী ও শিশুর সংখ্যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত নারী ও শিশুদের চেয়ে ৬ গুণ বেশি।

রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নিরলস আক্রমণের মধ্যে গাজায় নারী ও শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ছয় গুণ ছাড়িয়ে গেছে। আর এটি এই অঞ্চলে মারাত্মক বর্বরতার বিষয়টিই সামনে আনছে।

তুরস্কের এই বার্তাসংস্থা বলছে, আনাদোলু ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ান-ইউক্রেনীয় যুদ্ধে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা এবং গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে নিহত নারী ও শিশুদের সংখ্যা সংকলন করেছে।

ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজায় প্রাণহানি

গাজা ভূখণ্ডের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ এবং আগ্রাসনের শুরু থেকে অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে ইসরায়েল আকাশ, স্থল এবং সমুদ্র থেকে নিরলসভাবে বোমাবর্ষণ করে চলেছে।

ফিলিস্তিনি সূত্রগুলোর মতে, অবিরাম এই হামলায় ইসরায়েল ৬৬ হাজার টনেরও বেশি বিস্ফোরক ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ গাজায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ১৮৩ টন বিস্ফোরক ব্যবহার করেছে ইসরায়েল।

এছাড়া হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং ভূখণ্ডটির ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। একই সময়ে ইসরায়েলের হামলায় ২৯ হাজার ৪১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১২ হাজার ৬৬০ জন শিশু এবং ৮ হাজার ৫৭০ জন নারী রয়েছেন।

এছাড়া নৃশংস এই হামলায় আরও ৬৯ হাজার ৪৬৫ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যেও ৭০ শতাংশেরও বেশি নারী ও শিশু।

যদিও ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও চাপা পড়ে থাকা হাজার হাজার লোকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া হাসপাতাল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো স্থাপনায় হামলা চালিয়ে বেসামরিক অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে। মূলত আগ্রাসনের জেরে বাস্তুচ্যুত হওয়া ক্ষতিগ্রস্তরা এই ধরনের স্থাপনাতেই আশ্রয় নিয়ে থাকে।

ফিলিস্তিনিরা এখন একদিকে যেমন চলমান নিরলস আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করছে, অন্যদিকে অসহায় এসব মানুষের জন্য এই অঞ্চলে সাহায্য আনার বিষয়টিও ইসরায়েলের বাধার মুখে পড়ছে এবং মানুষ আরও বেশি করে ক্ষুধার সম্মুখীন হচ্ছে।

জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, ইসরায়েলের তীব্র আক্রমণের কারণে গাজা উপত্যকায় ২২ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হচ্ছে।

জাতিসংঘ বলেছে, ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) অনুসারে, গাজার ৩ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ পঞ্চম স্তরের বিপর্যয়মূলক ক্ষুধার সম্মুখীন এবং ৯ লাখ ৩৯ হাজার মানুষ চতুর্থ স্তরে বা জরুরি স্তরের ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছে।

এছাড়া গাজা উপত্যকার মানবিক পরিস্থিতি অমানবিক বলে উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস গত বুধবার ফিলিস্তিনি এই ভূখণ্ডকে ‘ডেথ জোন’ বা ‘মৃত্যু অঞ্চল’ বলে অভিহিত করেছেন।

তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গুরুতর অপুষ্টি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে, কিছু অঞ্চলে এর হার এক শতাংশের নিচে থেকে ১৫ শতাংশেরও বেশি, যা আরও অনেক বেশি মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ইসরায়েলের হামলার কারণে নিরাপদে সহায়তা বিতরণের অনুমতি দেওয়ার শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত উত্তর গাজায় জীবন রক্ষাকারী খাদ্য সহায়তা বিতরণ স্থগিত করেছে।

ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) ঘোষণা করেছে, ইসরায়েলের আগ্রাসনের কারণে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় থাকতে বাধ্য হওয়া উত্তর গাজার ফিলিস্তিনিরা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

এমনকি উত্তর গাজার ফিলিস্তিনিরা ময়দা তৈরির জন্য পশুখাদ্য পিষতে বাধ্য হচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বেসামরিক মৃত্যু

ইউএন হিউম্যান রাইটস মনিটরিং মিশন ইন ইউক্রেন (এইচআরএমএমইউ) অনুসারে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের জেরে শুরু হওয়া যুদ্ধে ১০ হাজার ৩৭৮ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ২ হাজার ৯৯২ জন নারী এবং ৫৭৯ জন শিশু। যুদ্ধে আহত হয়েছেন আরও ১৯ হাজার ৬৩২ জন।

এর মধ্যে মোট ৮ হাজার ৯৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে এবং ২ হাজার ২৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে অবৈধভাবে রাশিয়ায় সংযুক্ত করা অঞ্চলে। এইচআরএমএমইউ বলেছে, প্রাণহানির এই সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে।

অর্থাৎ গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের হাতে নিহত নারী ও শিশুর সংখ্যা গত দুই বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত নারী ও শিশুর সংখ্যার চেয়ে ছয় গুণ বেশি।

গাজাবাসীদের জন্য নেই কোনও আশ্রয়স্থল

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হামলার কারণে লক্ষাধিক ইউক্রেনীয় - যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু - তাদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

ইউক্রেনকে সমর্থনকারী ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু গাজার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েলি স্থল, আকাশ ও সমুদ্র অবরোধের অধীনে রয়েছে এবং প্রায় ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার (১৩৯ বর্গ মাইল) এলাকায় আটকা পড়ে আছে।

এছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নিরলস হামলা চললেও গাজার ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় নেওয়ার কোনও নিরাপদ জায়গাই নেই। উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ গাজায় আক্রমণের কারণে প্রায় ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি ৬৪ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত রাফাহ শহরে আশ্রয় নিয়েছেন।

জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, রাফাহ শহরের জনসংখ্যা গত ৭ অক্টোবরের আগে ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার। তবে ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর শহরটিতে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের অভিবাসনের কারণে জনসংখ্যা পাঁচ গুণেরও বেশি বেড়েছে। এতে বোঝা যায়, গাজার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এই শহরের ছোট ছোট জমিতে আশ্রয় নিয়েছে।

এছাড়া পর্যাপ্ত আবাসনের অভাবের কারণে রাফাহতে আশ্রয় নেওয়া বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি অস্থায়ী তাঁবুতে বাস করছেন এবং সেখানেই বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছেন। আর এবার ইসরায়েলি সরকার রাফাহতেও স্থল হামলার ইঙ্গিত দিয়েছে।

রাফাহতে হামলা হলে সেখানে আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনিরা আরও কঠিন দিনের মুখোমুখি হবে। এছাড়া ইসরায়েলের কারণে এই অঞ্চলে অসহায় মানুষের কাছে পর্যাপ্ত সাহায্যও পৌঁছানো যাচ্ছে না।

টিএম