মিয়ানমারের সামরিক জান্তাবিরোধী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের গ্রুপ পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) ও জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর (ইএও) দেশজুড়ে শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা তীব্র বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্রোহীদের ক্রমবর্ধমান হামলার মুখে গত তিন দিনে মিয়ানমারে জান্তা বেশ কিছু সৈন্যসহ আরও চারটি ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এর মধ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়নের সদরদপ্তরও রয়েছে।

বুধবার থাইল্যান্ড-ভিত্তিক মিয়ানমারের ইংরেজি দৈনিক দ্য ইরাবতির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জান্তা বাহিনী সাগাইং অঞ্চলের একটি শহর পুনরুদ্ধারের চেষ্টা শুরু করেছে। সম্প্রতি পিডিএফের যোদ্ধারা শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। শহরটিতে বর্তমানে জান্তা বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের তুমুল লড়াই চলছে।

দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন, সাগাইং, ম্যাগওয়ে, মান্দালয় এবং তানিনথারি অঞ্চলজুড়ে সেনা-বিদ্রোহী সংঘর্ষ চলছে। রাখাইনের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি বলেছে, প্রায় এক মাসের নিরবচ্ছিন্ন হামলার পর মঙ্গলবার মিনবিয়া শহরের বাইরে জান্তা বাহিনীর লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ৩৭৯ ও ৫৪১ ব্যাটালিয়নের সদরদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা।

• রাখাইনে দুটি ঘাঁটি হারিয়েছে জান্তা

মিনবিয়ার প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যম বলেছে, দুটি সামরিক ঘাঁটি দখলের সময় কয়েক ডজন জান্তা সৈন্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এএ যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

এর আগে, একই এলাকায় গত ২৮ জানুয়ারি লাইট ইনফ্যান্ট্রি ৩৮০ ব্যাটালিয়নের সদরদপ্তরও দখলে নেয় আরাকান আর্মির যোদ্ধারা। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিমান ও গানবোট থেকে গোলাবর্ষণ সত্ত্বেও সেটি বিদ্রোহীদের দখলে যায়।

আরাকান আর্মি বলেছে, তাদের যোদ্ধারা গত তিন দিনের হামলার পর মঙ্গলবার বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মংডু শহরে জান্তার সীমান্তরক্ষী ঘাঁটি তাউং পিয়ো দখলে নিয়েছে। এর আগে, রোববার তাউং পিয়োর ফাঁড়িগুলোতে একযোগে আক্রমণ শুরু করে আরাকান আর্মির যোদ্ধারা। একই দিনে তাউং পিয়োর ডান পাশের সামরিক ঘাঁটি দখলে নেওয়া হয়।

অবিরাম হামলার মুখে টিকতে না পেরে কয়েক ডজন জান্তা সৈন্য সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি। তারা বলেছে, দুটি ফাঁড়িতে আরাকান আর্মির প্রবল আক্রমণের কারণে দুই শতাধিক জান্তা সৈন্য ও পুলিশ কর্মকর্তা বাংলাদেশে পালিয়েছে।

মঙ্গলবারও রাখাইনের ম্রাউক-ইউ, কিয়াউকতাও, রামরি, অ্যান এবং মাইবোন শহরে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। গত ১০ দিনে উত্তর রাখাইনে অন্য আরও দুটি জান্তা ঘাঁটি দখলে নিয়ে আরাকান আর্মি।

• সাগাইংয়ের কাওলিন শহর পুনর্দখলের চেষ্টা জান্তার, পিডিএফের সাথে তুমুল লড়াই

মঙ্গলবার সাগাইং অঞ্চলের কাওলিন শহরে স্থানীয় পিডিএফ গোষ্ঠীগুলোর সাথে জান্তা সৈন্যদের ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। জান্তা বাহিনীর অন্তত ছয়টি সৈন্য দল একাধিক দিক থেকে কাওলিন পুনর্দখলের চেষ্টা করে। বর্তমানে এই শহরটি মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকারের (এনইউজি) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে প্রতিরোধ গোষ্ঠী ও বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

গত ৬ নভেম্বর শহরটির দখল নেয় এনইউজি ও পিডিএফের যোদ্ধারা। এরপর থেকে শহরটিতে ঘন ঘন বোমা হামলা চালাচ্ছে জান্তা বাহিনী। এর ফলে কাওলিনে অনেক বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার শহরটির নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে বিমান থেকে হামলা ও কামানের গোলা ছোড়া হয়েছে।

• ম্যাগওয়ে শহরে জান্তা-নিযুক্ত প্রশাসক নিহত

সোমবার ম্যাগওয়ে অঞ্চলের ইয়েসাগিওতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে শহরটির জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর চ্যান মায়া অংসহ অন্তত তিনজনকে হত্যার দাবি করেছে প্রতিরোধ গোষ্ঠী পিডিএফ।

পিডিএফের যোদ্ধারা ইয়েসাগিও শহরের প্রবেশপথে মেজর এবং তার সহকর্মীদের বহনকারী ছোট গাড়ি লক্ষ্য করে অতর্কিত হামলা চালায়। জান্তা বাহিনীর ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ২৫৮ থেকে শহরে ফেরার পথে তাদের ওপর হামলা চালানো হয় বলে জানিয়েছে পিডিএফ।

• ম্যাগওয়ে শহরে জ্বালানি ট্যাংক বহনকারী সামরিক গাড়িতে অতর্কিত হামলা

মঙ্গলবার ম্যাগওয়ে অঞ্চলের সিকফিউ শহরে জ্বালানি ট্যাংক বহনকারী জান্তার একটি গাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে প্রতিরোধ যোদ্ধারা। এই হামলায় সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ অন্তত দুই সৈন্য নিহত হয়েছে। পিডিএফের পাকোক্কু জেলার ব্যাটালিয়ন-৪ এই হামলার সমন্বয় করেছে বলে জানিয়েছে গোষ্ঠীটি।

পিডিএফ জানিয়েছে, স্থল মাইনের বিস্ফোরণ ঘটানোর পর সামরিক বাহিনীর গাড়িটি রাস্তার পাশে উল্টে যায়। পরে প্রতিরোধ যোদ্ধারা গাড়িতে থাকা দুই জান্তা সৈন্যকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। একই সঙ্গে সেখান থেকে দুটি ভারী আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়।

• তানিনথারিতে জান্তার ঘাঁটি দখল

দেশটির সামরিক জান্তাবিরোধী প্রতিরোধ গোষ্ঠী বা হতু আর্মি বলেছে, সোমবার তানিনথারি অঞ্চলের দাওয়েই শহরে জান্তার দুটি ব্যাটালিয়নের সদরদপ্তরের কাছের মে ওয়ে পাহাড়ের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়েছে। দাওয়েই কালেকটিভ কলাম নামের একটি প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সাথে যৌথভাবে হামলা চালিয়ে এই ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে।

অভিযানের সময় প্রতিরোধ বাহিনী ঘাঁটি থেকে কিছু সামরিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করেছে।

• মান্দালয়ের মাইংইয়ানে তীব্র সংঘর্ষ

সোমবার রাতে মান্দালয় অঞ্চলের মাইংইয়ান শহরের দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা তীব্র লড়াইয়ের পর মায়াউক কিয়ুন গ্রামে জান্তার ৮০ জন সৈন্যের একটি সামরিক ঘাঁটি দখলের চেষ্টা করেছে প্রতিরোধ যোদ্ধারা। পিডিএফ সহযোগী প্রতিরোধ গোষ্ঠী এনগাজুনও এই হামলায় অংশ নিয়েছে।

সূত্র: দ্য ইরাবতি।

এসএস