৩২ বছর আগের ভয়াল সেই স্মৃতি ফিরে আসছে অযোধ্যার মুসলিমদের মনে
গত কয়েক বছর ধরে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ধর্মীয় বিভাজননীতি যেভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে, রাম মন্দির উদ্বোধনের পর থেকে তা আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করছেন অযোধ্যার মুসলিমরা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন বিজেপির ৫০ বছরের প্রকল্প অযোধ্যার রাম মন্দির উদ্বোধন হয়েছে আজ।
ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশের ছোট শহর অযোধ্যায় শ্রীরাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের, যিনি এই ধর্মের একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় দেবতা। ‘রামের জন্মভূমি’ বলে পরিচিত অযোধ্যায় অতীতে বিশাল একটি রামমন্দির ছিল বলেও তথ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে।
বিজ্ঞাপন
ভারতের মোগল সাম্রাজ্যের স্থপতি সম্রাট জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবরের নির্দেশে তার সেনাপতি মীর বাকি সেই মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, যা পরিচিতি পায় ‘বাবরি মসজিদ’ নামে। মোগল আমলের শেষ উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল শুরু হওয়ার পর ১৯৮৫ সালে প্রথম মসজিদ ভবনের বাইরে দেবতা শ্রীরামের শৈশবকালীন মূর্তি ‘রামলালা’ স্থাপনের অনুমতি চেয়েছিলেন জনৈক হিন্দু সাধু মোহন্ত রঘুবীর দাস, কিন্তু তার সেই আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছিল।
তারপর প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় এই নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিতর্ক চলার পর ১৯৯২ সালে বিজেপির অভিভাবক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) নেতৃত্বে একদল উগ্র করসেবক (আরএসএসের কর্মীবাহিনী) বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে। এ ঘটনার জেরে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয় ভারতে এবং সেই দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন অন্তত ২ হাজার মানুষ। এই নিহতদের মধ্যে ছিলেন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ।
বর্তমানে অযোধ্যায় বসবাস করেন ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ, তাদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩২ বছর পর আজ নতুন প্রতিষ্ঠিত রাম মন্দিরের উদ্বোধনের পর দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও প্রকট হবে কি না— এমন আশঙ্কায় ভুগছেন অনেক ভারতীয় মুসলিম।
অযোধ্যার বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী মাওলানা বাদশাহ খান মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে জানিয়েছেন, ৩২ বছর আগের সেই ভয়াবহ দাঙ্গার ক্ষত এখনও ভুলতে পারেননি অনেক মুসলিম। মন্দির উদ্বোধনের দিন বাড়ি থেকে বের হবেন না বলেও জানান তিনি।
সিএনএনকে বাদশাহ খান বলেন, ‘আমরা যতই নীরব থাকি না কেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ক্ষত কখনও শুকাবে না। নতুন ভারতে মুসলিমদের অবস্থান আসলে কোথায়— রাম মন্দির তার সর্বশেষ উদাহারণ।’
সোমবার মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্রীড়া, বিনোদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ ও সেলিব্রেটিসহ ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে নিমন্ত্রণ করেছে বিজেপি। আমন্ত্রিত অতিধিদের মধ্যে মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের নেতারাও রয়েছেন।
ইতোমধ্যে এই অতিথিদের অধিকাংশই অযোধ্যায় উপস্থিত হয়েছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে ফুল ও অন্যান্য উপহারও এনেছেন অনেকে।
মন্দিরের এমন জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও অনেক মুসলিমের মধ্যে আতঙ্ক ধরাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অযোধ্যার মুসলিমদের স্থানীয় নেতা আজম কাদরি।
‘যখনই আমরা অযোধ্যায় নতুন লোকজনের আগমন ঘটে, আমরা আতঙ্কিত হই। ৩২ বছর আগের দাঙ্গায় হারিয়ে যাওয়া স্বজন, সঞ্চয় ও পরিচিতির দুঃসহ স্মৃতি আমাদের মনে পড়ে যায়। সবকিছু ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করা খুব সহজ কাজ নয়,’ সিএনএনকে বলেন কাদরি।
১৯৯২ সালের দাঙ্গায় নিজের পরিবারের দুই সদস্যকে হারানো হাজি মাহবুব বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে যে হারে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন দেখা দিয়েছে, আমার ভয় হচ্ছে হয়তো আর কিছুদিন পর অযোধ্যা থেকে মুসলিমদের বহিষ্কার করা হবে।
অযোধ্যা থেকে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন বিজেপির সংসদ সদস্য লাল্লু সিং অবশ্য এই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘সবার নিরাপত্তা দেওয়া হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও আশঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।’
তার কথায়, ‘যেভাবে অযোধ্যার অন্য বাসিন্দারা থাকছেন, সংখ্যালঘুরাও সেভাবেই থাকেন, থাকবেন। নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখি আমরা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো যা কাজ করছেন, সবার উন্নতির জন্যই করছেন।’
‘সেখানে কেউ এটা বলতে পারবে না যে এই ধর্মের মানুষের জন্য বাড়তি কিছু করা হয়েছে বা অন্য ধর্মের জন্য কম করা হয়েছে। আমাদের সংগঠন কখনই আমাদের বলে নি যে কারও থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চল, কারণ ভারতের নাগরিক তো সবাই।’
তবে এমপির কথায় তেমন ভরসা পাননি হাসান আলী। ১৯৯২ সালের ভয়াবহ দাঙার সময় নিজের পরিবার পরিজনকে হারিয়েছেন তিনি। আত্মরক্ষার জন্য স্থায়ী পুলিশ স্টেশনে আশ্রয় নেওয়া হাসান আলীর বয়স সে সময় ছিল মাত্র ৯ বছর।
সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে সময় স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবও ছিল। এমনকি দাঙার সময় মুসলিমদের বাঁচাতে স্থানীয় হিন্দুরা এগিয়ে এসেছেন— এমন শত শত উদাহারণ রয়েছে। স্থানীয় হিন্দুরা এগিয়ে না এলে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তো।’
‘কিন্তু এখনকার বাস্তবতা ভিন্ন। গত প্রায় দুই দশক ধরে মানুষের মনে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢোকানো হয়েছে, তাতে কার মনে কী চিন্তা চলছে— তা আর এখন বোঝার উপায় নেই। সামনের দিনগুলোতে কী হবে— তা ও বলার উপায় নেই।’
সূত্র : সিএনএন, বিবিসি
এসএমডব্লিউ