স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের ৩ জন শীর্ষ কর্মকর্তা এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র এবং বাইডেনের অন্যতম উপদেষ্টা জন কিরবি শুক্রবার ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই এ ইস্যুতে (নেতানিয়াহুর সঙ্গে) ভিন্নমত পোষন করি।’

বাইডেন প্রশাসনের অপর এক জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যদি তার (নেতানিয়াহু) এই বক্তব্যকে চুড়ান্ত বিলে ধরে নেই, তাহলে একদিকে গাজায় মানবিক সহায়তার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, অন্যদিকে সেখানে আটক জিম্মিদের মুক্তিও আটকে যাবে— যা কখনও কাম্য নয়। এছাড়া আরও অনেক বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।’

‘সেসব ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব। দ্বিরাষ্ট্র সমাধান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা থামবে না।’

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার শুক্রবার এক ব্রিফিংয়ে এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘গাজা উপত্যকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ, আর উপত্যকাকে পুনর্গঠন করা স্বল্পমেয়াদী চ্যালেঞ্জ। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছাড়া এই দুই চ্যালেঞ্জের কোনোটিই মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের তেল আবিব শহরে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু স্পষ্ট জানিয়ে দেন, জর্ডান নদীর পশ্চিমে পুরো এলাকার নিরাপত্তায় ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণেেই থাকতে হবে।

ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় ওই এলাকাও রয়েছে।

‘এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত এবং এটি (ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের) সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমি বিষয়টি আমার মার্কিন বন্ধুদের জানিয়েছি এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এমন বাস্তবতা চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা থামিয়ে দিয়েছি,’ সংবাদ সম্মেলনে বলেন নেতানিয়াহু।

ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তার গোটা রাজনৈতিক জীবন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে কাটিয়েছেন। গত মাসে তা গর্ব করে ঘোষণাও করেছিলেন তিনি। ফলে তার এই মন্তব্য খুব একটা অপ্রাত্যাশিত ছিল না।

কিন্তু গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান ভয়াবহ অভিযান এবং উপত্যকায় মৃত্যুর মিছিল ইসরায়েলের সবচেয়ে পুরনো ও বিশ্বস্ত মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে এই ইহুদি রাষ্ট্রটির সম্পর্ককে তলানিতে নিয়ে গেছে বলে ধারণা অধিকাংশ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকের।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ইরেজ সীমান্তে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সামরিক-বেসামরিক ইসরায়েলি ও বিদেশি নাগরিকসহ ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে হামাস যোদ্ধারা। সেই সঙ্গে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায় আরও ২৪০ জন ইসরায়েলি এবং বিদেশি নাগরিককে।

১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে সেদিন প্রথম একদিনে এতজন মানুষের হত্যা দেখেছে ইসরায়েল। অভূতপূর্ব সেই হামলার জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী এবং তার এক সপ্তাহ পর বিমান বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও।

ইসরায়েলি বাহিনীর লাগাতার বোমাবর্ষণে গত প্রায় সাড়ে তিন মাসে গাজায় নিহত হয়েছেন ২৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার এবং ইসরায়েলি বাহিনীর বোমাবর্ষণে ধসে যাওয়া বিভিন্ন ভবনের ধ্বংস্তূপের নীচে এখন ও চাপা পড়ে আছেন অন্তত কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি।

গত ২৫ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘোষিত এক মানবিক বিরতির সাত দিনে মোট ১০৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। বাকি ১৩২ জন এখনও তাদের হাতে আটক রয়েছে।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে মিত্র ইসরায়েলের পাশেই দাঁড়িয়েছিল এবং গত সাড়ে ৩ মাসে হোয়াইট হাউজ বার বার ইসরায়েলের সামরিক নীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে আসছে। বিশেষ করে নির্বিচারে বিমান হামলার পরিবর্তে আরও নির্ভুল অস্ত্র ব্যবহার, স্থল আক্রমণ নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি গাজা সংঘাত শেষে  ‘দ্বি-রাষ্ট্র’ সমাধানের দিকে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু ওয়াশিংটনের পরামর্শ হয় সঠিক জায়গায় পৌঁছায়নি কিংবা সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময়ও একই চিত্র দেখা গেছে।

সূত্র : সিএনএন, রয়টার্স

এসএমডব্লিউ