উত্তর ইরাকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কার্যালয়ে এবং সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অবস্থান লক্ষ্য করে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। হামলার পর মঙ্গলবার তেহরানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়েছে ইরাক। একই সঙ্গে বাগদাদে ইরানের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকেও তলব করা হয়েছে।

ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) বলেছে, তারা উত্তর ইরাকের আধা-স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চলে ইসরায়েলের গুপ্তচরবৃত্তির কাজে নিয়োজিত একটি কার্যালয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম সোমবার গভীর রাতে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে। দেশটির এই অভিজাত বাহিনী বলেছে, তারা সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধেও হামলা চালিয়েছে।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির উদ্বেগকে আরও গভীর করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশে বিরোধ ছড়িয়ে পড়েছে।

ওই অঞ্চলে ইরান-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেন থেকে হামলা চালাচ্ছে। ইসরায়েলে হামলার পাশাপাশি লোহিত সাগরে মার্কিন ও ইসরায়েলি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক জাহাজে প্রায়ই ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা করছে গোষ্ঠীগুলো।

ইরাকের সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর অংশ হিসেবে কাজ করা ইরান-সংশ্লিষ্ট মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর ওপর মার্কিন হামলার পর ইরাক আবারও আঞ্চলিক সংঘাতের কেন্দ্র হতে পারে বলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ওই অঞ্চলে মার্কিন বাহিনীর ওপর কয়েক ডজন হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান-সংশ্লিষ্ট মিলিশিয়াদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

আইআরজিসি বলেছে, সোমবার ভোরের দিকে ওই অঞ্চলে গাজা যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রথম সরাসরি সামরিক হামলা চালিয়েছে ইরান। গাজায় সংঘাত শুরু হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের চারপাশে ইরানের কয়েকজন কমান্ডার এবং ইরানের মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চালানো ‘‘নৃশংসতার’’ জবাবে এই হামলা করা হয়েছে।

ইরানি হামলার প্রতিবাদে তেহরানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে ইরাক। পাশাপাশি বাগদাদে ইরানের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকেও তলব করা হয়েছে। ইরাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেবে বাগদাদ।

কুর্দিস্তানের রাজধানী ইরবিলে মার্কিন কনস্যুলেটের কাছে একটি আবাসিক এলাকায় ইরানের হামলার নিন্দা জানিয়েছেন কুর্দি প্রধানমন্ত্রী মাসরুর বারজানি। তিনি এই হামলার ঘটনাকে ‘‘কুর্দি জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ’’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরানের চালানো ওই হামলায় কমপক্ষে চার বেসামরিক নিহত ও আরও ছয়জন আহত হয়েছেন।

হামলার পর সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈঠকের ফাঁকে বারজারি বলেছেন, ইরাকে ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তির ঘাঁটি নিয়ে ইরান যে অভিযোগ করেছে তা ভিত্তিহীন। তবে এই বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ইসরায়েলি সরকারের মন্তব্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

ইরানের হামলায় কুর্দিস্তানের ধনকুবের ও ব্যবসায়ী পেশরাউ দিজাই এবং তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য নিহত হয়েছেন। ইরাকি এই ধনকুবেরের বাড়িতে একটি রকেট আঘাত হানায় হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে দেশটির নিরাপত্তা ও চিকিৎসা সূত্র জানিয়েছে।

হামলার পক্ষে যুক্তি দিয়ে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেছেন, তেহরান অন্যান্য দেশের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করে। ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি প্রতিহত করার আইনি অধিকার রয়েছে।

আইআরজিসি বলেছে, কুর্দিস্তানে হামলার পাশাপাশি তারা সিরিয়ায় কয়েকটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এই হামলার মাধ্যমে ইসলামিক স্টেটসহ ইরানে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে জড়িত অপরাধীদের ধ্বংস করা হয়েছে।

• বেপরোয়া

চলতি মাসে ইরানে অন্তত দুটি বিস্ফোরণের ঘটনায় দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অভিজাত শাখা কুদস ফোর্সের সাবেক শীর্ষ কমান্ডার কাসেম সোলেইমানির শোকসভায় অংশ নেওয়া লোকজনকে লক্ষ্য করে আইএসের চালানো হামলায় অন্তত ১০০ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হন।

আইআরজিসি বলেছে, ‘‘শহীদদের রক্তের শেষ বিন্দুর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত’’ হামলা অব্যাহত থাকবে। গত মাসে সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের তিন কর্মকর্তার প্রাণহানির কথা উল্লেখ করে এই হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই তিন কর্মকর্তা সিরিয়ায় আইআরজিসির সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন।

এদিকে, হামলার মাধ্যমে ইরান ইরাকের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছে ফ্রান্স। একইভাবে ওয়াশিংটন ইরানি হামলাকে ‘‘বেপরোয়া’’ হিসেবে উল্লেখ করে এর নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইরাকে মার্কিন কোনও স্থাপনায় হামলা হয়নি এবং কোনও মার্কিনিও হতাহত হননি।

ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধে হামাসকে সমর্থনকারী ইরান গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েল অপরাধযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থনের পাশাপাশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের অত্যধিক প্রাণহানির ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন।

অতীতেও ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে হামলা চালিয়েছে ইরান। দেশটি বলেছে, ওই এলাকাটি ইরানের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি তেহরানের চিরশত্রু ইসরায়েলি এজেন্টদের ‘‘মঞ্চ স্থল’’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ২০২৩ সালে তেহরানের সাথে সাক্ষরিত একটি নিরাপত্তা চুক্তির অংশ হিসেবে বাগদাদ ওই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে ইরানের উদ্বেগ মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। সেখানকার কিছু সদস্যকে অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত করতে চলেছে বাগদাদ।

অন্যদিকে, মঙ্গলবার ইরাকের ইরবিল বিমাবন্দরের ওপর থেকে তিনটি সশস্ত্র ড্রোনকে গুলি চালিয়ে ভূপাতিত করা হয়েছে বলে ইরাকের কুর্দিস্তান কাউন্টার টেররিজম সার্ভিস জানিয়েছে। তবে এই ড্রোন হামলার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনও গোষ্ঠী দায় স্বীকার করেনি।

সূত্র: রয়টার্স।

এসএস