ফেসবুক খুললেই দেখা মিলছে তার। অনেকেই ছবি দিচ্ছেন তার সঙ্গে। আর লিখছেন একটি ইংরেজি শব্দ— সরি। কথা হচ্ছে রবার্টকে নিয়ে। সে একটি পুতুল, যার বাস সুদূর ফ্লোরিডায়। সেখানকার ফোর্ট ইস্ট মার্টেলো মিউজিয়াম তার ঠিকানা। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় শোরগোল ফেলে দিয়েছে সে।

কাঠের চেয়ারের উপর বসে থাকা ছোট্ট ছেলে রবার্ট। পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে তার বসার বিশেষ ভঙ্গিমায় ফুটে ওঠে ফুরফুরে মেজাজ। তবে রবার্টের চোখমুখে যেন গভীর চিন্তার ছাপ। রবার্টের পরনে নাবিকের পোশাক। মাথায় টুপি। হাতে একটি ছোট্ট কুকুর। তার সঙ্গেই যেন দিনরাত সুখ দুঃখের গল্প করে ছোট্ট রবার্ট। কিন্তু এই ছোটখাটো নিষ্পাপ পুতুলটিকে নিয়ে এত ভয় কেন?

রবার্ট আসলে ‘ভূতুড়ে পুতুল’। তার চোখের উদাসীন ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠেন অনেকে। ঝুঁকি না নিয়ে তড়িঘড়ি শেয়ার করে দেন রবার্টের ছবি, সঙ্গে লেখেন দুটি শব্দ— ‘সরি রবার্ট’।

রবার্ট এবং তাকে বলা এই পাঁচ অক্ষরের শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১১৯ বছরের ইতিহাস। ফ্লোরিডার মিউজিয়ামে রবার্টকে আনা হয় ১৯৯৪ সালে। তার আগে এই পুতুলের ঠিকানা ছিল ফ্লোরিডার কি ওয়েস্ট শহরের ওটো পরিবারের বাড়ি।

রবার্ট ইউজিন ওটো কি ওয়েস্টের এক নামজাদা চিত্রকর ছিলেন। তাকে তার ছোটবেলায় তার দাদু জার্মানি থেকে একটি পুতুল এনে দিয়েছিলেন। পুতুলের নামও মালিকের নাম অনুসারে রাখা হয়।

শোনা যায়, ওটো বড় হয়ে যাওয়ার পরও কখনো ওই পুতুলের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়নি। সে যেখানে যেত, পুতুলটি থাকত তার সঙ্গে। এমনকি ওই পুতুলের সঙ্গে সে নিয়মিত কথা বলত, গল্প করত, ভাগ করে নিত মনের কথা। আশপাশের মানুষের কাছে ওটোর এই আচরণ একেবারেই স্বাভাবিক ঠেকত না। অনেকে আড়ালে তাকে নিয়ে হাসাহাসিও করতেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলায়নি। ওটোর কাছে যেন ওই পুতুল ছিল জ্যান্ত বন্ধু।

জানা যায়, পুতুলটি তৈরি করেছিল জার্মানির স্টেইফ কোম্পানি। তবে তারা এই পুতুল সম্ভবত বিক্রি করার জন্য তৈরি করেননি। ঘর সাজানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। বর্তমানে রবার্টের পরনে পোশাকও প্রথম থেকে একরকম ছিল না। ছোটবেলায় ওটো যে পোশাক পরতেন, তা-ই পরে পুতুলটিকে পরানো হয়।

শোনা যায়, ছোট থেকেই ওটো তার নিজের অপরাধমূলক কাজের দায় চাপাত এই পুতুলের ওপর। সে একটু বড় হতে না হতেই পুতুলটির মধ্যে অলৌকিক গুণ প্রকট হতে শুরু করে। অনেকে বলেন, ওটোর বাড়ির জানালার ওপরে পুতুলটি রাখা থাকত। মাঝে মাঝেই নাকি সে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যেত। ওটোর বাড়ি এড়িয়ে চলতেন অনেকেই।

১৯৭৪ সালে ওটোর মৃত্যুর পর তাদের বাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। পুতুলটি তখনো সেখানেই ছিল। অনেকে নাকি ওই বাড়ির ছাদে হাঁটাচলা এবং মাঝে মাঝে অট্টহাসির শব্দ শুনতে পেতেন। বাড়িজুড়ে নাকি ঘুরে বেড়াত ‘ভূত-পুতুল’। অনেকে আবার বলেন, কেউ ওই পুতুলের সামনে তাকে বা ওটোকে অপমান করে কথা বললে পুতুলের মুখের হাবভাব পাল্টে যেত।

ওটোর মৃত্যুর পরও ২০ বছর ওই বাড়িতে ছিল রবার্ট পুতুল। তারপর তাকে জাদুঘরে দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে যেন রবার্টের কাহিনিতে মোড় ঘুরে গেছে। একাধিক সিনেমা, টিভি শোতে এই পুতুল ব্যবহার করা হয়েছে। রবার্টের জন্যই ধীরে ধীরে ভিড় বেড়েছে মিউজিয়ামে। তাকে নিয়ে বইও লেখা হয়েছে অনেক।

ফ্লোরিডার ওই মিউজিয়াম থেকে রবার্টের প্রতিরূপ কেনা যায়। অনেকে আবার চাইলে টাকা দিয়ে তার সঙ্গে অন্ধকার ঘরে সময়ও কাটাতে পারেন। অনেক দর্শনার্থী রবার্টকে দেখে যাওয়ার পর চিঠি লিখে পাঠান। রবার্টকে লেখা সে সব চিঠিতে থাকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা। সবাই পুতুলটিকে ‘সরি’ বলেন।

শোনা যায়, রবার্টকে যারা দেখে গেছেন, তারপর নাকি তাদের জীবনে নেমে এসেছে দুর্ভাগ্যের আঁধার। দুঃসময় যেন কাটতেই চায় না তাদের জীবনে। তারা অনেকে পরে চিঠি লিখে রবার্টের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।

মানুষের বিশ্বাস, রবার্ট পুতুলকে কোনোভাবে অশ্রদ্ধা বা অসম্মান করলে জীবনে নেমে আসে অভিশাপ। সেই কাহিনিই এখন নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সবাই পুতুলটিকে ‘সরি’ বলতে শুরু করেছেন।

ফ্লোরিডার মিউজিয়ামের দর্শকদের অনেকে দাবি করেছেন, তারা যখন পুতুলটির ছবি তোলার চেষ্টা করেছেন, সেই মুহূর্তে ক্যামেরা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মিউজিয়াম থেকে বের হওয়ার পর আবার নাকি ঠিক হয়ে গেছে ক্যামেরাগুলো। অর্থাৎ, রবার্ট চায় না তার ছবি তোলা হোক।

মিউজিয়ামের কর্মীদের দাবি, কাচের পাত্রের ভেতরে রাখলেও মাঝেমধ্যে দেখা যায়, রবার্ট কাচের গায়ে হাত দিয়ে রয়েছে। কখনো বা দর্শনার্থীদের দিকে ভয়াল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় রবার্টকে।

অনেকে ফ্লোরিডার রবার্টকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর পুতুল’ বলে আখ্যা দেন। অনেকে বলেন, এই পুতুলের ওপর বহু বছর আগে কোনো ‘কালা জাদু’ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তার ফলে সে অলৌকিক কাণ্ড ঘটাতে শুরু করে।

রবার্টের কাণ্ডকারখানা অবশ্য অলিক কল্পনা বলেই উড়িয়ে দেন অনেকে। তাদের মতে, অন্ধবিশ্বাস, ভয় বা কুসংস্কার থেকে লোকের মুখে মুখে এ ধরনের কাহিনি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ প্রচারের পেছনে কারো কারো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলেও মনে করা হয়।

এসএসএইচ