যুক্তরাষ্ট্র যখন কোনও প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন— নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্তদের সঙ্গে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকরা লেনদেন করতে পারেন না | ছবি: সংগৃহীত

প্রায় দুই বছর আগে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক হামলা চালায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে সেনারা ইউক্রেনে ঢুকে পড়ার পর— শাস্তি দিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় দেশটি জানায়, সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত রাখলে আরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী, মস্কোর বিরুদ্ধে অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ওয়াশিংটন।

প্রথম ধাপে রাশিয়ার দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক— যেগুলো সেনাবাহিনীকে সেবা দিচ্ছিল— সেগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এরপর দেশটির বৈদেশিক ঋণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত পশ্চিমা অর্থনীতি থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

কিউবা থেকে মিয়ানমার, চীন থেকে ইরানসহ বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি মানতে বাধ্য করতে এসব দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এরমাধ্যমে প্রতিপক্ষকে শাস্তি, মানবাধিকার লঙ্ঘন অথবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অথবা আলোচনায় বাধ্য করা হয়।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কী এবং এটা কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অস্ত্র হয়ে উঠেছে?

• অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কী?

নিষেধাজ্ঞা হলো শাস্তি অথবা দমনমূলক ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক আইন ও শাসন মানতে— এক দেশ আরেক দেশের ওপর আরোপ করে থাকে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় মূলত থাকে ‘বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞার’ বিষয়টি। এটি বিস্তৃত হতে পারে। আর এই নিষেধাজ্ঞা পুরো দেশ অথবা অর্থনীতিকে লক্ষ্য করে আরোপ করা হয়। যেমন কিউবার ওপর দশকব্যাপী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। অথবা নির্দিষ্ট ক্ষেত্র, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি অথবা অন্যান্য সত্তাকে লক্ষ্য করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র যখন কোনও প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন— নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকরা সাধারণত লেনদেন করতে পারেন না। কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার পরিধি আরও বেশি হয়। যেমন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট তৃতীয় পক্ষের সঙ্গেও মার্কিন প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকরা বাণিজ্য করতে পারেন না। 

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এক তরফা হতে পারে। আবার মাঝে মাঝে তারা মিত্র অথবা সহযোগী প্রতিষ্ঠান— যেমন  ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং জাতিসংঘের সঙ্গে মিলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে।

• যুক্তরাষ্ট্রে নিষেধাজ্ঞা কীভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষ কংগ্রেস— উভয়েরই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষমতা রয়েছে। ১৯৭৭ সালের আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক শক্তি আইনের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রজেক্টের ওয়াশিংটন অফিসের পরিচালক আলী ভায়েজ বলেছেন, “বিশ্বের প্রায় সব বাণিজ্য যেহেতু মার্কিন ডলারে করা হয় এবং লেনদেনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে হয়; তাই যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মতো অবস্থানে রয়েছে। এরমাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা হয়।”

• যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে?

যুক্তরাষ্ট্র আগে যখন নিষেধাজ্ঞা দিতো, তখন সেগুলো পুরো দেশের ওপর আরোপ করা হতো। যেমন বর্ণবাদের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে দেশটি। এরবদলে বর্তমানে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। 

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ অফিসের (ওএফএসি) সাবেক পরিচালক জন ই-স্মিথ জানিয়েছেন এ তথ্য। এই প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করে থাকে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের জিওইকোনোমিকস সেন্টারের ফেলো ব্রায়ান ও’তোলে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান পরিবর্তন করে ২০০১ সালের ৯/১১ এর হামলার পর। ওই সময় সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক অর্থায়নের ওপর নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করে দেশটি।

আন্তর্জাতিক অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য, সঙ্গে প্রযুক্তিগত এবং আইনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের এসব প্রচেষ্টা সুফল পেয়েছে। প্রযুক্তিগত ও আইনগত পরিবর্তনের কারণে ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে বিশ্বব্যাপী অর্থ স্থানান্তর’ অনেক কঠিন।

এছাড়া গত কয়েক দশকে সেকেন্ডারি অথবা বহির্মুখী নিষেধাজ্ঞার ওপর নির্ভর করা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যেসব ‘তৃতীয় পক্ষ বা প্রতিষ্ঠান’ ব্যবসা-বাণিজ্য বা লেনদেন করেছে তাদেরও শাস্তির আওতায় এনেছে ওয়াশিংটন। এরমাধ্যমে অন্যদেরও নিষেধাজ্ঞা মানার ক্ষেত্রে বাধ্য করা হয়েছে। 

• যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পেয়েছে বড় যেসব দেশ

রাশিয়ার ওপর ২০২২ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন। বাইডেনের আগের প্রশাসনগুলোও নিজেদের নীতি মানতে বাধ্য করতে নিষেধাজ্ঞাকে ব্যবহার করেছে। এরমধ্যে রয়েছে ভেনেজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া। এছাড়া ইরানকেও নিষেধাজ্ঞার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। 

২০১৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। এর পরপরই তার নির্দেশে মার্কিন প্রশাসন ইরানের ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রথমে দেশটিকে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সুইফটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের তৈরি ইলেকট্রনিক পণ্যও যেন রাশিয়া না পায় সে ব্যবস্থা করা হয়। 

• নিষেধাজ্ঞায় কী ধরনের পরিবর্তন আনার আলোচনা চলছে?

কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নীতির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। কারণ যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়— সেটির বেশিরভাগই অর্জিত হয় না। 

কারণ নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট কোনও কাঠামো নেই। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কি না সেটিও দেখা হয় না। যে কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়— নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্তরা যদি সে বিষয়টি পরিবর্তন বা নিজেদের সংশোধন করে; এরপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার যে আশ্বাস যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে থাকে সেটিরও স্পষ্ট কোনও পদ্ধতি নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ অফিস (ওএফএসি); যেটি নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে, সেটি মাত্র একদিকেই চলে। যখন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়; তখন ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাইরের বিশ্বের সঙ্গে আবারও লেনদেন শুরু করতে পারবে কি না এ ব্যাপারটি নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা নেই ওএফএসির। 

সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।

এমটিআই/এসএস