বছরের পর বছরের দীর্ঘ পরিকল্পনা আর বিশদ ও নিখুঁত প্রস্তুতির পর গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী হামাস। গাজার এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা ডিজিটাল ডিভাইস ও নথি বিশ্লেষণে এমন তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

মঙ্গলবার সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে ইসরায়েলি একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মৃত কিংবা আটককৃত ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীদের কাছে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জামে এমন একটি হামলার বিশদ পরিকল্পনা দেখা যায়, যার লক্ষ্য ছিল ‘‘মানুষের মনোবল ভেঙে ফেলার মতো একটি আকস্মিক ধাক্কা’’ দেওয়া।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট, জিপিএস ডিভাইস, গোপ্রো ক্যামেরা, মানচিত্র এবং নোটবুক থেকে পাওয়া তথ্যে ‘‘কীভাবে সামরিক ঘাঁটি এবং কিব্বুতের বাসিন্দাদের ওপর হামলা চালাতে হবে’’ সে সম্পর্কে বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পনা করার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

গত ৭ অক্টোবর হামাস ও তাদের মিত্রগোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের অতর্কিত হামলা চালায়। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দিয়ে স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে শত শত হামাস যোদ্ধা ইসরায়েলে ঢুকে পড়েন। হামাসের এই হামলায় এক হাজার ২০০ জনের বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। একই দিন ইসরায়েলি ভূখণ্ড থেকে প্রায় ২৪০ জনকে ধরে নিয়ে গাজায় জিম্মি করে রাখে হামাস; যাদের অনেকেই বিদেশি।

জবাবে হামাসকে গাজা থেকে নির্মূল করার হুঙ্কার দিয়ে ওই উপত্যকায় নির্বিচার বোমা হামলা ও স্থল অভিযান পরিচালনা করে আসছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে। নিহত এই ফিলিস্তিনিদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু বলে গাজার হামাস-পরিচালিত  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

হামাসের যোদ্ধাদের কাছে থেকে উদ্ধার করা সরঞ্জাম বিশ্লেষণ করে ইসরায়েল অসংখ্য আরবি নথি ও লাখ লাখ ইলেকট্রনিক ডেটার পাঠোদ্ধারে আমশাত নামের একটি সামরিক গোয়েন্দা ইউনিটকে পুনরায় চালু করেছে। ইসরায়েলি এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, হামাস একই সঙ্গে ‘‘একটি যুদ্ধের পরিকল্পনাও’’ করেছিল। তিনি বলেন, হামাসের নিখুঁত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির মাত্রা সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের।

১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর আমশাত ইউনিট চালু করেছিল ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। ওই সময় মিসর ও সিরিয়ার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল ইসরায়েল। এই যুদ্ধের পর আরও কয়েকবার আমশাত ইউনিটটি চালু করা হয়েছিল। 

গত ১ ডিসেম্বর মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছরেরও বেশি সময় আগে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা হামাসের ৭ অক্টোবরের মতো হামলার এক পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে পেরেছিল। এতে হামলার বিশদ বিবরণ ধাপে ধাপে তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু এই পরিকল্পনাকে ‘‘কাল্পনিক’’ হিসেবে বিবেচনা করেছিল ইসরায়েলি বাহিনী।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী হামাসের গত ৭ অক্টোবরের হামলার এক বছরেরও বেশি সময় আগে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাসের এই ধরনের হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতো। হামাস যে এই ধরনের আকস্মিক হামলার শুরুর পরিকল্পনা করেছে, সেই বিষয়ে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর কাছে তথ্য ছিল। কিন্তু তারপরও কেন প্রাণঘাতী হামলা ঠেকাতে পূর্ব-সতর্কতামূলক কোনও ব্যবস্থা ইসরায়েল নেয়নি, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

হামাসের লড়াইয়ের পরিকল্পনা সম্পর্কে ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের কাছে ৪০ পৃষ্ঠার একটি নথি ছিল; যার কোড নাম ‘‘জেরিকো ওয়াল’’। ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসরত সম্প্রদায়ের ওপর হামাসের একটি কাল্পনিক অভিযানের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে এই নথিতে।

তবে ইসরায়েল কীভাবে হামাসের হামলার বিষয়ে গোপন এই নথি পেয়েছিল সেটি পরিষ্কার নয়। নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, গোপন ওই নথি ইসরায়েলি কর্মকর্তারা সরাসরি হামাসের কাছ থেকে জব্দ করে থাকতে পারেন বলে ইঙ্গিত মিলেছে। এছাড়া সম্ভবত আরবি ভাষার নথিটি অনুবাদও করা হয়েছে।

সূত্র: এএফপি।

এসএস