রূঢ় বাস্তবতা ফাঁস
যুদ্ধের সম্মুখ প্রান্তকে ‘নরক’ বলছেন ইউক্রেনীয় সৈন্য
ছয় মাস আগে রাশিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে ইউক্রেনের সেনারা। এই ছয় মাসের মধ্যে ইউক্রেনীয় বাহিনী বিস্তৃত দানিপ্রো নদীর অপর (পূর্ব) পাড়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। যেখানে শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করেছিল রুশ বাহিনী।
ইউক্রেনীয় সেনারা যখন দানিপ্রো নদী পার হয়ে অপরপ্রান্তে পৌঁছাতে সমর্থ হয়; তখন এটিকে নিজেদের অন্যতম বিজয় হিসেবে অভিহিত করেছিল ইউক্রেন ও পশ্চিমারা।
বিজ্ঞাপন
এমনকি বলা হয়েছিল, নদীর কাছ থেকে এখন রুশ সেনাদের হটিয়ে দেওয়া হবে এবং সেখানে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে। কারণ সেনারা সেখানে আক্রমণের পাদভূমি (ব্রিজহেড) তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে।
তবে যুদ্ধের সম্মুখ প্রান্তের এক সেনা প্রকাশ করেছেন যুদ্ধের রূঢ় বাস্তবতা। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, সত্যিকার অর্থে সেখানে কি হচ্ছে। ওই সেনা জানিয়েছেন, দানিপ্রো নদীর ওই পাড়ে এমন মেরিন সেনা রয়েছে; যারা সাঁতার পর্যন্ত জানেন না। কিন্তু তাদের যুদ্ধের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিবিসির কাছে পাঠানো ইউক্রেনীয় সেনার এ বার্তাটি হুবহু তুলে ধরা হলো—
‘নদী পারাপারের ওপর অব্যাহতভাবে হামলা চালানো হয়। আমি দেখেছি আমার সহকর্মীদের নৌকার ওপর হামলা চালানোর পর সেটি মিলিয়ে গেছে। চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে দানিপ্রো নদীতে।’
‘আমাদের সঙ্গে সবকিছু নিয়ে যেতে হয়— জেনারেটর, জ্বালানি এবং খাবার, যখন আপনি একটি আক্রমণের পাদভূমি তৈরি করবেন আপনার সবকিছু অনেক বেশি প্রয়োজন হবে। কিন্তু সরবরাহের পরিকল্পনা এই এলাকার জন্য করা হয়নি।’
‘নদী পার হওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম শত্রুরা (রুশ বাহিনী) পালিয়ে যাবে এবং আমরা ধীরসুস্থে প্রয়োজনীয় সবকিছু সেখানে নিয়ে যেতে পারব। কিন্তু বিষয়টি এমন ভাবে হয়নি।’
আরও পড়ুন
‘যখন আমরা নদীর পূর্বপ্রান্তে পৌঁছাই, শত্রুরা অপেক্ষা করছিল। যেসব রাশিয়ানকে আমরা আটক করতে সমর্থ হয়েছিলাম, তারা জানিয়েছে, আমাদের আগমনের ব্যাপারে তারা জানত। ফলে আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই, তারা জানত আমাদের কোথায় পাওয়া যাবে। তারা আমাদের ওপর কামান, মর্টার এবং ফ্লেম থ্রোয়ার সিস্টেম ব্যবহার করেছে। আমি ভেবেছিলাম আমি এখান থেকে কখনো বের হতে পারব না।’
‘আমরা প্রতিদিন জঙ্গলে বসে থেকে রুশদের হামলার শিকার হতাম। আমরা আটকে গিয়েছিলাম। রাস্তা-ঘাট সব মাইনে ঠাসা ছিল। রাশিয়ানরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না এবং আমরা এটি ব্যবহার করেছি। কিন্তু তাদের ড্রোন সবসময় আমাদের ওপর উড়ত। যখনই কোনো নড়াচড়া দেখত তখনই হামলা চালানো হতো ড্রোন থেকে।’
‘সরবরাহ ছিল সবচেয়ে ভঙ্গুর। রাশিয়ানরা আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নজরদারি চালাত। ফলে সরবরাহ আরও কঠিন হয়ে যায়— আমাদের সুপেয় পানির তীব্র অভাব দেখা দেয়। যদিও আমাদের সরবরাহ নৌকা এবং ড্রোনে করে আসত।’
‘আমরা নিজেদের খরচে অনেক কিছু কিনেছি— জেনারেটর, পাওয়ার ব্যাংক এবং শীতের পোশাক নিজেরা কিনেছি। সামনে তুষারপাত আসছে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আসল পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে— কেউ কোনো কিছু পরিবর্তন করতে পারবে না।’
‘কেউ জানে না লক্ষ্য কি। অনেকে মনে করে কমান্ডাররা আমাদের পরিত্যাগ করেছে। তারা বিশ্বাস করে দানিপ্রো নদীর অপর প্রান্তে আমাদের উপস্থিতি সামরিক গুরুত্বের চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। কিন্তু আমরা আমাদের কাজ করেছি এবং কৌশলগত দিকটিতে প্রবেশ করিনি।’
‘আমাদের সেনাদের বেশিরভাগ হতাহত হয়েছে ভুলের কারণে— কেউ পরিখার ভেতর দ্রুত প্রবেশ করতে পারেনি। কেউ ভালোভাবে লুকাতে পারেনি। কেউ যদি সজাগ না থাকে তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে সে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।’
‘কিন্তু আমাদের চিকিৎসকদের ধন্যবাদ। যদি তাদের কাছে আহত সেনাদের আমরা পৌঁছাতে পারি— তাহলে ওই সেনা বেঁচে যাবে। কিন্তু সবাইকে আমরা নিতে পারি না। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।’
‘একই সময় আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা শত্রুদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করছে। আমরা রুশ সেনাদের আটক করছি। কিন্তু তাদের কোথায় পাঠাব। যদি আমাদের আহত সহকর্মীদের নিয়ে নদী পার না হতে পারি, তাহলে কিভাবে হবে।’
আরও পড়ুন
‘একই সময় সেখানে একাধিক ব্রিগেড (কয়েক হাজার সেনা) থাকার কথা ছিল। আলাদা কোনো কোম্পানি নয়। আমাদের পর্যাপ্ত সেনা নেই।’
‘আমাদের সাথে অনেক তরুণ আছে। আমাদের সেনা দরকার। কিন্তু প্রশিক্ষিত সেনা। নতুন যুক্ত হওয়া সেনা নয়; যারা এখন আমাদের সাথে আছে। এখানে এমনও আছে যারা মাত্র তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং মাত্র কয়েকবার গুলি চালানোর সুযোগ পেয়েছিল।’
‘এটি একটি পুরোপুরি দুঃস্বপ্ন। এক বছর আগে, আমি হয়ত এটি বলতাম না। কিন্তু দুঃখিত, এখন আমি বিপর্যস্ত।’
‘যারা স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যোগ দিতে চেয়েছিল তারা অনেক আগেই এসেছিল। এখন মানুষদের অর্থ দিয়েও নেওয়া যাচ্ছে না। এখন আমরা সেনাবাহিনীতে এমন সদস্যদের পাচ্ছি যারা ড্রাফট থেকে নাম কাটাতে পারেনি। আপনি জেনে হাসবেন, আমাদের কিছু মেরিন সেনা সাঁতারও জানে না।’
এই সেনা জানিয়েছেন, মাইন বিস্ফোরণে আহত হওয়ার পর তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়। এরপর নতুন সেনাদের সেখানে পাঠানো হয়। নতুন যাদের পাঠানো হয়েছে তারা তাদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে। তবে কয়েকদিন পর তাকে আবারও সেই ‘নরক’ ফিরে যেতে হবে।
সূত্র: বিবিসি
এমটিআই