মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন গত রোববার দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইওলের বাসভবনে এক নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন। সেই নৈশভোজে দক্ষিণ কোরিয়ায় হামাসের মতো আকস্মিক হামলা উত্তর কোরিয়া চালাতে পারে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ইয়ুন সুক ইওল। উত্তর কোরিয়ার যেকোনও ধরনের হামলার বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়ার জন্য তিনি অস্টিনের প্রতি আহ্বান জানান।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আন্তঃসীমান্ত হামলা চালানোর পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিক ও প্রতিরক্ষা প্রধানরা এই ঘটনার সাথে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণে একই ধরনের হামলা চালাতে পারে বলে তুলনা করছেন।

গত মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যানও বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যদি দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে পিয়ংইয়ং যুদ্ধ শুরু করে, তাহলে সেক্ষেত্রে হামাসের আক্রমণের মতো একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে পারে বলে প্রমাণ রয়েছে।

কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া কি সত্যিই একই ধরনের হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে? নাকি এই সংঘাতকে ব্যবহার করে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার এবং উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কারণ দাঁড় করাচ্ছে?

গত অক্টোবরে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে একের পর এক রকেট নিক্ষেপ করে হামাস। পরে গোষ্ঠীটির গেরিলা যোদ্ধারা ইসরায়েলে ঢুকে হামলা চালায়। আর এই কৌশল হাইব্রিড যুদ্ধের অন্যতম প্রধান উদাহরণ হিসেবে পরিচিত। টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি মিলিটারি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো রিউ সুং-ইওপ বলেন, এই যুদ্ধের কৌশলে উত্তর কোরিয়া ঐহিত্যগতভাবে অত্যন্ত দক্ষ। দেশটি যদি হাইব্রিড যুদ্ধ শুরু করে তাহলে সিউল ভুগবে। 

৭ অক্টোবর হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলে ৫ হাজারের বেশি রকেট নিক্ষেপ করে হামাস। আর পিংইয়ংয়ের কামান থেকে মাত্র এক ঘণ্টায় অন্তত ১৬ হাজার রকেট ছুড়তে পারে। হুমকি মোকাবিলা করার জন্য ইসরায়েলের আয়রন ডোমের মতো নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করছে সিউল।

গাজায় হামাস যেভাবে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে, উত্তর কোরিয়াও প্রায় একই ধাঁচের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে বলে ধারণা করা হয়। আর সুড়ঙ্গের কিছু কিছু দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে উত্তর কোরিয়ার ডিমিলিটারাইজড জোন (ডিএমজেড) পর্যন্ত পৌঁছেছে। এসব সুড়ঙ্গে অস্ত্র মজুদ এবং সম্ভাব্য হামলার সময় তা ব্যবহার করা যায়।

• উত্তরের হুমকি কতটা বাস্তব?

উত্তর কোরিয়ার হামলার হুমকি গত কয়েক দশক ধরেই দক্ষিণের সর্বত্র বিরাজমান। আর দুই কোরিয়ার মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য হামলার ঘটনা ঘটেছিল ১৩ বছর আগে। ওই সময় উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা দক্ষিণের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করে। এতে দক্ষিণ কোরিয়ার দুই মেরিন সেনা ও বেসামরিক দুই নাগরিক নিহত হন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেছেন, ওই হামলার ঘটনার পর উত্তর কোরিয়ার কৌশলে আরও পরিবর্তন আনা হয়েছে। সংঘাতের সময় সীমান্ত অতিক্রম না করেই রাজধানী সিউলকে ধ্বংস করে দেওয়ার মতো ব্যবস্থা বা সক্ষমতা গড়ে তুলেছে উত্তর কোরিয়া।

কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ইউনিফিকেশনের উত্তর কোরিয়াবিষয়ক গবেষণা বিভাগের পরিচালক হং মিন বলেছেন, হামাস প্রধানত স্বল্প পাল্লার রকেটের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রের আওতা অনেক বেশি এবং তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের কামান রয়েছে। দেশটির হামলা চালানোর সক্ষমতা হামাসের চেয়ে অনেক গুণ বেশি।

দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের সাবেক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা চো সিওং রিউলের মতে, গত কয়েক বছরে পিয়ংইয়ং কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দাবি করেছে। পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার আরও উন্নত এবং মজুদ বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করেছে দেশটি। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার এখন হামাসের মতো কৌশল ব্যবহারের কোনও কারণ নেই। উত্তর কোরিয়া একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, তার নিজস্ব সেনাবাহিনী এবং পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।

কিয়ংনাম ইউনিভার্সিটির মিলিটারি স্টাডিজের বর্তমান এই অধ্যাপকের যুক্তি, উত্তর কোরিয়ার এখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কোনও আগ্রহ নেই। কারণ তাদের ইতোমধ্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র রয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছে, দক্ষিণে যেকোনও ধরনের আগ্রাসন চালানো হলে তা কিম জং উনের শাসনের অবসান ঘটবে। আর কিম জং উনের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। তা সত্ত্বেও ইসরায়েলে হামাসের হামলা দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণশীল সরকারের সীমান্তে নিরাপত্তা কঠিন করা উচিত কি না সেই প্রশ্নকেও সামনে এনেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রশাসন উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। দেশটির সামরিক শক্তিকে আরও শক্তিশালী করছে এবং সংলাপের পাশাপাশি হামলা হলে প্রতিশোধ নেওয়া হবে বলে হুমকিও দিয়েছে।

কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ইউনিফিকেশনের পরিচালক হং বলেছেন, প্রথমে উত্তর কোরিয়াকে হামলা চালানো থেকে বিরত রাখার দিকেই নজর দেওয়া উচিত। যদি হামাসের মতো একবারে সব অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় উত্তর কোরিয়া, তাহলে এই মুহূর্তে কোনও দেশই সেই হামলা থেকে নিজেদের পুরোপুরি রক্ষা করতে পারবে না।

সূত্র: বিবিসি।

এসএস