আরব-ইসরায়েলের মাঝে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ শুরু, সেটা চলছে এখনো। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৩ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আরব দেশগুলোর সঙ্গে আর কোনও যুদ্ধ না হলেও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ হয়নি।

যদিও সংঘাত বন্ধে শান্তির ফরমুলা হিসেবে বিভিন্ন সময় দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সেটা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাধান প্রথম এসেছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের মাধ্যমে। সে সময় বলা হয়, ইসরায়েল হবে ইহুদিদের জন্য এবং ফিলিস্তিন আরবদের জন্য।

তবে ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। যেটা আরবরা মানেনি। এর ধারাবাহিকতাতেই হয় প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। কিন্তু এক সময়ে এসে ঠিকই ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয়পক্ষই দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে ঐকমত্য হয়। কিন্তু সেটা কীভাবে হলো? এবং পরে কেন আবার ব্যর্থও হলো সেটা একটা বড় প্রশ্ন।

• দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে কী ছিল?

ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল পৃথক দুটি রাষ্ট্রের ধারণা প্রথমবারের মতো বাস্তবতার দিকে এগোতে শুরু করে ১৯৯৩ সালে নরওয়ের অসলোতে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। যেটা অসলো অ্যাকর্ড নামে পরিচিতি। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীর এবং গাজায় সরকার পরিচালনার জন্য একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়। এটা গঠনের সময়সীমা ছিল পাঁচ বছর।

অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা স্বীকার করে নেয় ইসরায়েল রাষ্ট্রকে। চুক্তি অনুযায়ী অবশ্য খুব দ্রুতই পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা নিয়ে সম্ভাব্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একটি কর্তৃপক্ষও গঠন করা হয়।

কিন্তু তারপরই শান্তি প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। নানারকম বাধা তৈরি হয়।

• শান্তি প্রক্রিয়া কেন স্থবির হল?

অসলোতে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেওয়া হলেও সেই রাষ্ট্র কবে গঠন হবে তার কোনও সময়সীমা বেধে দেয়া হয়নি। এমনকি ইসরায়েলের বাইরে আলাদা একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিষয়েরও কোনও সমাধান করা হয়নি।

এই চারটি বিষয় হচ্ছে, প্রথমত: দ্বি-রাষ্ট্র সীমান্ত কোথায়, কীভাবে নির্ধারণ হবে সেটা। দ্বিতীয়ত: জেরুজালেম কার অধীনে থাকবে। তৃতীয়ত: ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ভেতরে থাকা ইসরায়েলি বসতিস্থাপনকারীদের কীভাবে সরিয়ে নেয়া হবে। চতুর্থত: ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে ইসরায়েলের ভেতরে থাকা যেসব ফিলিস্তিনি বাস্তচ্যুত হয়েছেন, তারা ইসরায়েলে কীভাবে ফিরবেন।

চুক্তিতে বলা হয়েছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের পর এগুলো আলোচনার ভিত্তিতে পরে ঠিক করা হবে। কিন্তু সেটা আর কখনোই হয়নি। ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক বলছেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে দু’পক্ষেরই দায় ছিল।

বিবিসিকে তিনি বলেন, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন দুই পক্ষেই চুক্তি বিরোধী শক্তিশালী দুটি গ্রুপ ছিল, যারা এই ঐকমত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ দুই পক্ষই বলেছিল, পুরো এলাকা তাদের এবং শুধু তাদেরই রাষ্ট্র হবে। ফিলিস্তিনে এটা ছিল হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ। আর ইসরায়েলে ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলো। ফলে অসলো অ্যাকর্ড আর এগোয়নি।

কিন্তু ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির পরপরই এর বিরোধিতায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ ইহুদিদের ওপর হামলা শুরু করে। অন্যদিকে ইসরায়েলে একজন ইহুদি কট্টরপন্থীর হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শান্তিচুক্তি করা দেশটির প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন। ১৯৯৬ সালে ইসরায়েলে ডানপন্থীরা ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলের সরকারও আর শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে চায়নি।

পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় দুই পক্ষের বৈঠক হলেও সমাধান আসেনি। এ সময় ইসরায়েল মূলত নজর দিয়েছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের ওপর এবং জেরুসালেমকে তারা ইসরায়েলের রাজধানীও ঘোষণা করেছে।

সবমিলিয়ে ফিলিস্তিনে এখন যে ভৌগোলিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কি-না তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে।

• স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কি আর সম্ভব?

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য সবার আগে দরকার ভূখণ্ড। কিন্তু পশ্চিম তীর যেটা কি-না ফিলিস্তিনের অংশ হবে সেখানে এখন কয়েক লাখ ইহুদি বসতিস্থাপনকারী বসবাস করছেন। এছাড়া জেরুজালেমকেও ইসরায়েল তার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং আমেরিকা সেটাকে স্বীকৃতিও দিয়েছে।

ফলে ভৌগোলিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন এখন আর বাস্তব সম্মত নয় বলেই অনেকে মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক শাহিন বেরেনজি মনে করেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে।

বিবিসিকে তিনি বলেন, এটা বাস্তবায়ন করা ১৯৯০ এর দশকের তুলনায় খুবই কঠিন। কারণ, পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেমের ইহুদি বসতি। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির সময় এটা ছিল এক লাখ ২০ হাজার। গেল তিন দশকে ইহুদি বসতিস্থাপনকারী বেড়ে হয়েছে সাত লাখ। এছাড়া খোদ ইসরায়েলের আইন অনুযায়ীই অবৈধ এরকম ইহুদি বসতিও আছে।

তিনি মনে করেন, এরকম বসতি সম্প্রসারণ এবং ইসরায়েলের রাজনীতিতে এর প্রবল সমর্থনের কারণে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিও এখন আর ইসরায়েলের আগ্রহ নেই। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরাও হামাস এবং ফাতাহ দুই দলে বিভক্ত। এবং তাদের মধ্যে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য কথা বলা বা শান্তি প্রক্রিয়া এগোনোর মতো একক এবং বিশ্বস্ত নেতা নেই, বলেন তিনি।

• তাহলে কি দুই রাষ্ট্র সমাধান আর সম্ভব নয়?

ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক অবশ্য বলছেন, সুযোগ এখনো আছে। কিন্তু ইসরায়েল কি দুই রাষ্ট্র সমাধান আর চায়? লিটভ্যাক বলছেন, ইসরায়েল সেটা চায় না।

‘আমি এখানে ইসরায়েলের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করি। তারা যেটাকে সমাধান মনে করে সেটা হচ্ছে, পরিস্থিতি যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকুক। অর্থাৎ তারা পশ্চিম তীরকে নিয়ন্ত্রণ করবে, যেখানে আবার একটা ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষও থাকবে - তবে দুর্বল এবং ইসরায়েলের উপর নির্ভরশীল।’

কিন্তু চিরদিন ইসরায়েল এভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে এটা একটা ভুল ধারণা। এটা থেকে বেরিয়ে এলে সমাধান সম্ভব, বলছেন লিটভ্যাক।

লিটভ্যাক মানছেন ইহুদি বসতি একটা বড় সমস্যা। কিন্তু তিনি এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ইসরায়েল এর আগে গাজা থেকে তাদের সব বসতি সরিয়ে নিয়েছিল এবং নিজেরাও গাজার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছে। সুতরাং কঠিন হলেও পশ্চিম তীরে সেটা করা যাবে। এমনকি জেরুজালেম নিয়েও দু’পক্ষ ছাড় দিলে ঐকমত্যে আসা সম্ভব।

কিন্তু ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে এখন যে নতুন যুদ্ধাবস্থা, সেখানে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা অচলাবস্থার পরিবর্তন কে করবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মার্কিন গবেষক শাহিন বেরেনজি মনে করেন, এখানে আমেরিকাকেই আবার এগিয়ে আসতে হবে। তার মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তির উদ্যোগ নিলে সেটা সফল হতে পারে।

তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকা যখন মধ্যপ্রাচ্যে কিছু করতে চেয়েছে, তখন সেটার বাস্তবায়নও হয়েছে। মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তি, জর্ডানের সঙ্গে চুক্তি এমনকি সাম্প্রতিককালে আব্রাহাম অ্যাকর্ড-এর সবগুলোর পেছনে আমেরিকার ভূমিকা আছে।

কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ আছে কি না, এমন প্রশ্নে শাহিন বলছেন, দুই যুগ আগে নাইন-ইলেভেনের পর আমেরিকার চোখ অসলো শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন থেকে সরে যায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে।

সেটা শেষ হলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইরান, রাশিয়া, চীন নিয়ে। কিন্তু এখন আমেরিকাকে আবারো মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় হতে হচ্ছে। কারণ এখানে অবহেলা করলে এর ফল সবাইকেই ভোগ করতে হবে, কিছু সময় পর পর সংঘাত সামনে আসবে।

আমেরিকা শান্তির উদোগ নিলে হয়তো সেটা আশা দেখাতে পারে। কিন্তু এখন ইসরায়েল-গাজা সংকট যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিতে এগোচ্ছে, সেখানে আমেরিকা-ইসরায়েল কিংবা হামাস, শান্তির কথা কেউই বলছে না। সংকটটা এখানেই। বিবিসি বাংলা।

এসএস