ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলার প্রতিশোধ নিতে গাজা উপত্যকায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

স্থল হামলার আগে— ইহুদিবাদী ইসরায়েলের সেনাবাহিনী গাজার উত্তরাঞ্চলের ১১ লাখ বাসিন্দাকে দক্ষিণ দিকে সরে যেতে বলেছে। এরমধ্যে গাজার কাছে তারা ৩ লাখ সেনা, ট্যাংকসহ অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র জড়ো করেছে।

তবে গাজার মতো জনবহুল এলাকায় সেনা পাঠানোর বিষয়টি একটি ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান হবে।

গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযান কেমন হবে, এটির পরিধি কেমন হবে এবং কতদিন চলবে এ বিষয়টি নিশ্চিত নয়।

কখন শুরু হতে পারে স্থল হামলা?

সম্ভাব্য স্থল অভিযানের প্রস্তুতি ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সাবেক কর্মকর্তা এবং গাজায় পূর্বে স্থল অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া মেজর জেনারেল আমস গিলিড বলেছেন, হামলা শুরুর আগে ইসরায়েলের প্রধান কাজ ছিল— সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়ার জন্য একটি জরুরি সরকার গঠন। সেটি হয়ে গেছে।

এছাড়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যেসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইসরায়েল সফর করেছেন তারা স্থল অভিযানের ক্ষেত্রে সবুজ সংকেত দিয়েছেন। তবে বেসামরিক মানুষ— এমনকি সেনাদের মধ্যে হতাহত কেমন হবে সে বিষয়টিও এই স্থল অভিযানের বিষয়টি ঠিক করবে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের কয়েকজন রিজার্ভ সেনার সঙ্গে কথা বলেছে। যাদের সবার মধ্যে যুদ্ধ করার আকাঙ্খা রয়েছে এবং তারা গাজায় সামরিক হামলা চালাতে মনের দিক দিয়ে উজ্জীবিত আছে।

বিবিসি নিসিম নামের এক রিজার্ভ সেনার কথা উল্লেখ করেছে। এই সেনা হামাসের হামলার সময় শ্রীলঙ্কায় ছিলেন। কিন্তু হামলার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিতে ইসরায়েলে ফিরে এসেছেন তিনি।

বিবিসি জানিয়েছে, ইসরায়েলিদের মধ্যে এখন উদ্দীপনা এবং ঐক্য দেখা যাচ্ছে এবং তারা সবাই মনে করে গাজায় হামলা চালানো উচিত। তবে গাজায় হামলা চালানোর নির্দেশ যত দেরিতে দেওয়া হবে তাদের মধ্য থেকে সেই উদ্দীপনা কমে যেতে পারে।

ইসরায়েল যেহেতু শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) ফিলিস্তিনিদের গাজার উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিতে সরে যেতে মাত্র ২৪ ঘণ্টার সময় বেধে দিয়েছে; এটির অর্থ হলো তারা যে কোনো সময় হামলা শুরু করবে।

হামলার প্রস্তুতি

হামাস হামলা চালানোর পর ইসরায়েলের প্রথম কাজ ছিল— হামাসের যেসব যোদ্ধা ইসরায়েলে প্রবেশ করেছেন তাদের হত্যা করা, আটক করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।

ইসরায়েলে একটি গানের উৎসবে হামলার পর সেখানে টহল দিতে দেখা যায় ইসরায়েলি সেনাদের

স্থল হামলার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে গাজায় ব্যাপক বোমা হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। তারা যুদ্ধের প্রথম ৬ দিনেই গাজায় ৬ হাজার বোমা ফেলেছে। যেখানে পুরো ২০১১ সাল জুড়ে ন্যাটো লিবিয়ায় ৭ হাজার ৭০০ বোমা ফেলেছিল। গাজায় ইসরায়েলিদের নির্বিচার বিমান হামলায় এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

গাজায় অভিযান কেমন হবে সেটি গোপন রাখবে ইসরায়েল। তবে সেখানে এ ধরনের অভিযান চালানার জন্য কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েল। গাজার মতো শহরে কীভাবে হামলা চালানো হবে সে ব্যাপারে নিজ সেনাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রস্তুত করেছে তারা।

শহুরে যুদ্ধ এবং হামাসের গোপন সুড়ঙ্গ

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ইয়াকোভ আমিদরোর স্বীকার করেছেন— হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অনেক কঠিন হবে। কারণ সশস্ত্র এ গোষ্ঠী গাজার প্রবেশদ্বারে এবং ইসরায়েলি বাহিনীর পথে বিভিন্ন ফাঁদ পাতবে এবং বিস্ফোরক স্থাপন করবে।

ইসরায়েলের বিশ্বাস হামাসের ৩০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে।  আর তাদের কাছে রয়েছে অটোমেটিক রাইফেল, রকেট প্রপেলড গ্রেনেড এবং ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র— যেগুলোর কিছু কিছু রাশিয়ার কর্নেটস এবং ফাগোটসের।

এছাড়া হামাসের কাছে প্রচুর রকেট রয়েছে। যেগুলো তারা যুদ্ধের শুরু থেকেই ছুড়ে আসছে।

মেজর জেনারেল ইয়াকোভ আরও জানিয়েছেন, হামাস নিজেই আত্মঘাতীসহ কিছু ছোট ড্রোন উৎপাদন করছে। এছাড়া হামাসের কাছে স্বল্প সংখ্যক স্বল্পপাল্লার সোল্ডার-লঞ্চড সারফেস টু এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। কিন্তু তাদের কাছে যেসব অস্ত্র নেই সেগুলো হলো— ট্যাংক, সাঁজোয়া যান এবং কামান; যেগুলো ইসরায়েলের রয়েছে।

হামাসের সেনাদের কাছে অটোমেটিক রাইফেলসহ বিভিন্ন অস্ত্র রয়েছে

ইসরায়েলের জন্য যেটি কঠিন হবে সেটি হলো জনবহুল শহরে যুদ্ধ করা।

তবে সুড়ঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ইসরায়েলের বিশেষ বাহিনী রয়েছে।

তিনি জানিয়েছেন, খুব বেশি প্রয়োজন না পড়লে ইসরায়েল হামাসের গোপন সুড়ঙ্গে প্রবেশ করবে না। তবে হামাস এসব সুড়ঙ্গ সম্পর্কে বেশি জানে এ কারণে নয়। এর বদলে এসব সুড়ঙ্গ বিস্ফোরক ব্যবহার করে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করবে ইসরায়েলি বাহিনী।

ইসরায়েলের লক্ষ্য কী?

ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো হামাসকে সামরিকভাবে দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।

মেজর জেনারেল গিলিড, ‍যিনি ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে ৩০ বছর কাজ করেছেন, তিনি বলেছেন, এবার ইসরায়েলের লক্ষ্য বড় কিছু। এর আগে ইসরায়েল গাজায় যেসব স্থল হামলা চালিয়েছিল— সেগুলোর লক্ষ্য ছিল হামাসকে আটকে রাখা। কিন্তু এবার এমন কিছু করা হবে যেন, ইসরায়েলের অন্যান্য আঞ্চলিক শত্রু ইরান ও হিজবুল্লাহ যেন এ থেকে শিক্ষা নেয়।

অপরদিকে মেজর জেনারেল ইয়াকোভ বলেছেন, এবার ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো হামাসের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করে দেওয়া। যেন তারা পুনরায় ইসরায়েলে আর কোনো হামলা চালাতে না পারে।

তবে সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে— স্থল অভিযান যে লক্ষ্য নিয়ে শুরু করা হয়, সেটি খুব কমই অর্জিত হয়।

যুদ্ধ বিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইনস্টিটিউট অব স্ট্রেটেজিক স্টাডিসের লেফটেনেন্ট জেনারেল স্যার টম বেকেট বিবিসিকে বলেছেন, মাত্র ৪০ কিলোমিটার লম্বা গাজায় সামরিক অভিযানের ফলাফল কী হবে সেটি বেশ পরিষ্কার। তার মতে, হামাসকে হয়ত নির্মূল করা হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে হামাসের যে সমর্থন সেটি থেকেই যাবে।

সূত্র: বিবিসি

এমটিআই