ইসরায়েলকে যেভাবে ধোঁকা দিলো হামাস
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ নামের যে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে হামাস তার পেছনে কাজ করেছে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীটির দীর্ঘ ও সুচতুর কৌশল ও পরিকল্পনা; যা প্রাথমিকভাবে প্রায় হতবুদ্ধিকর অবস্থায় ফেলেছিল অধিকৃত জেরুজালেমের শাসকগোষ্ঠীকে।
শনিবার ভোর থেকে যে হামলা শুরু করেছে হামাস, তা ১৯৭৩ সালের পর ইসরায়েলের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এবং আন্তর্জাতিক অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক। ইসরায়েলেও স্বীকার করেছে, এই সময়ে এত বড় একটি হামলার আশঙ্কা আগে তাদের কল্পনাতেও আসেনি। প্রসঙ্গত, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর একটি।
বিজ্ঞাপন
রয়টার্সকে আইডিএফ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত প্রায় ২ বছর ধরে হামাসের নীরব থাকার কৌশলে তারা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন এবং বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, গাজা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণকারী এই সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীটি হয়তো যুদ্ধের পথ পরিহার করতে চায়।
কিন্তু শনিবার থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ তাদের সেই ধারণা ভয়ানকভাবে পাল্টে দিয়েছে। এখন যেকোনও মূল্যে নিজেদের সেই ‘ভুল’ শুধরে নিতে বদ্ধপরিকর তারা।
হামলার প্রথম দিন শনিবার ভোরের দিকে ইসরায়েলের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থাপনাকে লক্ষ্য করে একের পর এক রকেট ছোড়া শুরু করে হামাস। সেই সঙ্গে সীমান্ত দিয়ে ইসরায়েলের ভেতরে প্রবেশ করে নির্বিচারে সামরিক-বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করতে থাকে।
হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে অপ্রস্তুত এবং খানিকটা হতবাক হয়ে গেলেও, দ্রুত সেই অবস্থা কাটিয়ে পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করে আইডিএফ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দিনে ইসরায়েল ও গাজা ভূখণ্ডে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি মানুষ এবং আহত হয়েছেন আরও কয়েক হাজার। এই হতাহতদের মধ্যে সামরিক-বেসামরিক উভয়ই রয়েছেন।
এর আগে, ২০২১ সালের জুনে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে ব্যাপক রকেট হামলা চালিয়েছিল হামাস। সেবার অবশ্য ইসরায়েলের খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ৯০ শতাংশেরও বেশি রকেট ঠেকিয়ে দিতে পেরেছিল আইডিএফ।
১০ দিন ধরে বিরতিহীনভাবে হাজার হাজার রকেট ছোড়ার পর একাদশতম দিনে মিসরের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল হামাস। তারপর প্রায় ২ বছর পর্যন্ত ইসরায়েলের অভ্যন্তরে তো বটেই, এমনকি সীমান্ত অঞ্চলেও কোনও গণ্ডগোল করেনি স্বাধীনতাকামী এই কট্টরপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠী।
ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের জন্য শনিবার বিশেষ পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই ধর্মের অনুসারীদের কাছে শনিবার দিনটি কেবলমাত্র প্রার্থনার জন্য বরাদ্দ এবং ইসরায়েলে এটি সাপ্তাহিক ছুটির দিন।
হামাসের গত তিনদিনের হামলায় ইসরায়েলে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৮ শতাধিক ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিক, আহত হয়েছেন আরও কয়েক হাজার। আইডিএফের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের পূর্ব প্রস্তুতির অভাব এবং শনিবারের কর্মবিরতির কারণে হতাহতের সংখ্যা এই পরিমাণ বেড়েছে।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর নির দিনার এই হামলাকে ২০০১ সালের টুইন টাওয়ারের হামলার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘এখন আমরা নাইন ইলেভেনের মধ্যে রয়েছি। হামাস আমাদের এই অবস্থায় এনে ফেলেছে।’
এর মধ্যেই গাজার সাধারণ লোকজনকে সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ ও কাজের অনুমতি দেয় দখলকৃত জেরুজালেমের ইহুদি শাসকগোষ্ঠী। এতে দারিদ্রপীড়িত গাজা ভূখণ্ডের অর্থনৈতিক অবস্থাতেও বদল আসা শুরু করেছিল একটু একটু করে। কিন্তু হামাসের উচ্চপর্যায়ের এক নেতা রয়টার্সের কাছে স্বীকার করেছেন যে, গত দুই বছরের নীরবতা ছিল আসলে একটি ছল মাত্র।
রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘এট ছিল হামাসের একটি ভান বা কৌশল। আমরা ইসরায়েলকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে, হামাস আর যুদ্ধ চায় না। কিন্তু এই সময়সীমার মধ্যে আমরা আমদের যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্রভাণ্ডার শক্তিশালী করেছি এবং কোথায়-কখন-কীভাবে হামলা শুরু হবে তার পরিকল্পনা করেছি।’
‘তাছাড়া ইসরায়েলকে ধোঁকার মধ্যে রাখতে গত কয়েক মাস ধরে আমরা নিত্যনতুন গোয়েন্দা কৌশল নিচ্ছিলাম, যা এর আগে কখনও নেওয়া হয়নি। এমনকি গাজার সাধারণ লোকজনও আঁচ করতে পারেনি যে আমরা কী করতে যাচ্ছি। কেউই ভাবতে পারেনি আমরা ইসরায়েলকে প্রস্তুত হওয়ার কোনো প্রকার সুযোগ না দিয়ে এত বড় একটি অপারেশন চালাতে যাচ্ছি।’
হামাসের লেবানন শাখার প্রতিনিধি ওসামা হামদান রয়টার্সকে বলেন, ‘হামাসের এই হামলা প্রমাণ করে যে, ইসরায়েল যতই সামরিক ও অন্যান্য সক্ষমতা থাকুক না কেন— ফিলিস্তিনের জনগণ তাদের লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’
• যেভাবে হামলা চালাল হামাস
২০২২ সালের যুদ্ধের পর বেশ স্তিমিত হয়ে পড়েছিল হামাস। আর যেহেতু সেই যুদ্ধবিরতির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মিসর, তাই ইসরায়েলও বেশ নিশ্চিন্ত ছিল গাজা ও এবং হামাস নিয়ে।
এই যুদ্ধের কয়েক মাস পর গাজা ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের ইসরায়েলে কাজ করার অনুমতি দেয়। গাজার বাসিন্দাদের জন্য কয়েক হাজার পারমিটও ইস্যু করে অধিকৃত জেরুজালেমের শাসকগোষ্ঠী।
ফলে একদিকে দারিদ্র্য ও বেকারত্বের ঘায়ে জর্জরিত গাজা ভূখণ্ডের অর্থনীতিতে গতি আসা শুরু করে, অন্যদিকে নতুন কোনও হামলার লক্ষণ না থাকায় ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১০ কিলোমিটার প্রস্থ গাজা উপত্যকা এবং এই উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী সম্পর্কেও অনেকটাই নিশ্চিন্ত বোধ করছিলেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাবাহিনী ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এছাড়া গত কয়েক মাস ধরে পশ্চিম তীর এলাকায় কট্টরপন্থী বিভিন্ন ইসলামী গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত ছোটোখাটো সংঘাত চলছিল ইসরায়েলি বসতিস্থাপনকারীদের। দ্বন্দ্বের মাত্রা তেমন বড় না হলেও এক পর্যায়ে বসতিস্থাপনকারীদের রক্ষার স্বার্থে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাবাহিনী। ফলে ওই সময়ে গাজা সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে তেমন চিন্তিত ছিল না অধিকৃত জেরুজালেম।
হামাসের উচ্চপর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, গোটা অপারেশনকে চারটি ধাপে ভাগ করা হয়েছিল এবং হামলার নির্দিষ্ট দিন শনিবার শেষ রাত থেকে গাজা ভূখণ্ডে একের পর এক গ্রেনেড ছোড়া শুরু হয়। কাছাকাছি সময়ে হ্যাং গ্লাইডার ও মোটরচালিত গ্লাইডারে চেপে হামাসের বেশ কয়েকজন যোদ্ধা সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমাণ্ডের কার্যালয়ে গিয়ে সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের বন্দি ও জিম্মি করার পাশাপাশি ওই কমান্ডের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মূল কমান্ড ও অন্যান্য শাখার কার্যালয়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মোটরসাইকেল ও জীপে করে সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ করেন আরও কয়েকশ’ হামাস যোদ্ধা, শুরু হয় যুদ্ধ।
• ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
শনিবার শুরুতে খানিকটা অপ্রস্তুত হলেও পরে খুব দ্রুত পূর্ণ উদ্যোমে যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসে ইসরায়েল। আইডিএফের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের এবারের মিশন হামাসকে ঝাড়ে-বংশে নির্মূল করা।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ইয়াকোভ অ্যামিদ্রোর রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা হামাসকে বিশ্বাস করেছিলাম এবং এটিই ছিল আমাদের ভুল। এখন সেই ভুল আমরা শুধরে নেব।’
‘হামাসকে আমরা চিরতরে শেষ করে দেব। আজ না হোক কাল, এ বছর না হোক আগামী বছর… যত সময় লাগুক না কেন, হামাসকে আমরা শেষ করবই।’
এসএমডব্লিউ