টিকা নিয়ে টানাটানি ভারতে
ভারতে চলমান করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেই টিকা ঘাটতি নিয়ে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। তবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. হর্ষবর্ধন টিকা ঘাটতির কথা মানতে নারাজ। তিনি জানিয়েছেন, কিছু কিছু রাজ্য সরকার নিজেদের ব্যর্থতার নজর অন্য দিকে সরাতে ও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে এ ধরনের গুজব রটাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ভারতের মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্রিশগড়, হরিয়ানা, ওড়িশা ও তেলেঙ্গানা রাজ্যগুলোতে টিকার ঘাটতি রয়েছে। মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য দুটির সরকার জানিয়েছে যে তারা কেন্দ্রকে টিকার ঘাটতির বিষয়ে জানিয়েছে। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন জানান যে টিকা সরবরাহের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। কয়েকটি রাজ্য টিকাদানের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ।
বিজ্ঞাপন
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যকর্মী ও ফ্রন্টলাইন কর্মীদের টিকাদানের ব্যাপারেও মহারাষ্ট্র সরকারের উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। ফ্রন্টলাইন কর্মীদের ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র সরকার ৮৬ শতাংশকে প্রথম ডোজ দিয়েছে। আর দিল্লি ৭২ শতাংশ ও পাঞ্জাবে ৬৪ শতাংশ। যেখানে ১০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ৯০ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রথম ডোজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
মহারাষ্ট্র মাত্র ৪১ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বিতীয় ডোজ দিয়েছে। দিল্লি ৪১ শতাংশ ও পাঞ্জাব ২৭ শতাংশ ডোজ দিয়েছে। আর ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ৬০ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্যকর্মীদের ডোজ সম্পন্ন করেছে।
মন্ত্রী আরও বলেন, মহারাষ্ট্রে টিকার ঘাটতি নিয়ে দেওয়া বিবৃতি দেখেছি। করোনা ঠেকাতে মহারাষ্ট্র সরকার বারবার ব্যর্থ। ফলে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে সরাতে এটা বাজে চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। জনগণের মধ্যে তারা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এটা পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলেছে। টিকা সরবরাহের ওপর নজরদারি চলছে। রাজ্য সরকারগুলোকে টিকা সরবরাহের ব্যাপারে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে। টিকার ঘাটতি বিষয়টি একেবারে ভিত্তিহীন অভিযোগ।
এর আগে বুধবার মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ টোপে জানিয়েছেন যে তিনি কেন্দ্রকে টিকার ঘাটতির কথা অবগত করেছেন। মহারাষ্ট্রে ১৪ লাখ ডোজ বাকি রয়েছে। যা দিয়ে তিন দিন স্থায়ী হবে। রাজ্যে প্রতি সপ্তাহে ৪০ লাখ ডোজ টিকার প্রয়োজন। তবেই রাজ্য দৈনিক ৬ লাখ করে টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবে। টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকে মহারাষ্ট্রে এখনও পর্যন্ত ৮২ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সরবরাহে বিলম্ব করায় করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন কোভিশিল্ডের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়াকে (এসআইআই) আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে এর উদ্ভাবক কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা। ভ্যাকসিনের উৎপাদন বাড়াতে সিরাম ইনস্টিটিউট প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদর পুনাওয়ালা মন্তব্য করার একদিন পর এই আইনি নোটিশ পেল।
মঙ্গলবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া এক স্বাক্ষাৎকারে আদর পুনাওয়ালা বলেছিলেন, অন্যান্য দেশে কোভিশিল্ডের বড় ধরনের চালান সরবরাহ স্থগিত করছে সরকার। যে কারণে তাদের কাছে ভ্যাকসিনের চালান সরবরাহে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। বিদেশে এই ভ্যাকসিন অনেক উচ্চ দামেও বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে এই ভ্যাকসিনের দরকার। কিন্তু আমরা এই মুহূর্তে ভারতের চাহিদাকেও প্রাধান্য দিচ্ছি। আমরা এখনো প্রত্যেক ভারতীয়র কাছে— যাদের এই ভ্যাকসিন দরকার; তাদের সরবরাহ করতে পারছি না।
গত সপ্তাহে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার জানায়, ভ্যাকসিন রফতানিতে কোনো ধরনের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা নেই। অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের এই টিকা প্রত্যেক মাসে প্রায় ছয় থেকে সাড়ে ছয় কোটি ডোজ উৎপাদন করছে সেরাম ইনস্টিটিউট।
সেরাম এখন পর্যন্ত ভারত সরকারকে ১০ কোটি ডোজ দিয়েছে ও বিদেশে ৬ কোটি ডোজ রফতানি করেছে। বিশ্বজুড়ে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আগামী জুনের মধ্যে আরো ৩ হাজার কোটি রুপি দরকার বলে জানান আদরপুনাওয়ালা। ভারতে বর্তমানে দৈনিক ২০ লাখ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড উৎপাদন করছে সেরাম। পাশাপাশি দেশটিতে ভর্তুকি দিয়ে প্রতি ডোজ টিকা ১৫০ রুপিতে বিক্রি করছে পুনের এই প্রতিষ্ঠান।
আদরপুনাওয়ালা বলেন, আমরা ভারতে প্রায় ১৫০ থেকে ১৬০ রুপিতে ভ্যাকসিনটি সরবরাহ করছি। কিন্তু এটির গড় মূল্য ২০ ডলারের মতো। নরেন্দ্র মোদির সরকারের অনুরোধে আমরা ভর্তুকি দিয়ে এই টিকা সরবরাহ করছি। আমরা যে লাভ করছি না বিষয়টি তেমন নয়... তবে আমরা অতি লাভ করছি না; যা পুনর্বিনিয়োগের প্রধান চাবিকাঠি।
এদিকে বুধবার (৭ এপ্রিল) ভারতে ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৩৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে দৈনিক আক্রান্তের হিসাবে দেশটিতে এখন পর্যন্ত এটাই সর্বোচ্চ।
নতুন করে এক লাখ ১৫ হাজারের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পাশপাশি ভারতে একদিনে সক্রিয় রোগী বেড়েছে ৫৫ হাজার ২৫০ জন। একইসঙ্গে বর্তমানে মোট সক্রিয় রোগীর সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৩ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে মারা গেছেন ৬৩০ জন। এ নিয়ে দেশটিতে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজার ১৭৭ জনে।
মহামারি শুরুর পর থেকে গত সোমবার ভারতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রথমবারের মতো এক লাখের গণ্ডি পার হয়। পরদিন মঙ্গলবার প্রায় ৯৭ হাজার মানুষের শরীরে শনাক্ত হয় ভাইরাসটি।
সারা ভারতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলেও মহারাষ্ট্রের অবস্থা যেন একটু বেশিই খারাপ। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যটিতে ৫৫ হাজারেরও বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। একই সময়ের মধ্যে সেখানে মারা গেছে ২৯৭ জন। ভারতের মোট সক্রিয় রোগীর প্রায় অর্ধেক কেবল মহারাষ্ট্রেই।
মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি কর্নাটক, ছত্তিশগড়, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ুতেও পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছত্তিশগড়ে। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। করোনার প্রথম পর্বেও এতটা খারাপ পরিস্থিতি ছিল না রাজ্যটিতে। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে মারা গেছেন ৫৩ জন।
কর্নাটকের মতো দিল্লির অবস্থাও দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ১০০ জন। গত বছর ২৭ নভেম্বরের পর এই প্রথম দিল্লির দৈনিক সংক্রমণ ৫ হাজার ছাড়াল।
উত্তরপ্রদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৯৫ জন। পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশেও দৈনিক আক্রান্ত হচ্ছেন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ। অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান, হরিয়ানাতেও দৈনিক আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ২ হাজারের গণ্ডি। তেলেঙ্গানা, বিহার, ঝাড়খণ্ডেও বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা।
এদিকে করোনার সংক্রমণ রুখতে ভারতের নানা অংশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাজধানী নয়াদিল্লিতে রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়। এপ্রিলের ৩০ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন সেখানে রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কারফিউ জারি থাকবে। এসময়ে জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি এবং টিকাদান কেন্দ্রে যাওয়া ব্যক্তিরাই কেবল রাস্তায় থাকতে পারবেন।
ওএফ