কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে জড়িত বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর গত জুন মাসে কানাডায় খুন হন। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে ভারতের সরকারি এজেন্টদের সংশ্লিষ্ট থাকার ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ আছে বলে সোমবার মন্তব্য করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তার এই মন্তব্যের পর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে তোলপাড় চলছে। ইতিমধ্যে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক বহিষ্কার করেছে উভয় দেশ।

ভারত-কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্ক হঠাৎ করে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে শিখ ধর্মাবলম্বীদের ভারতে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও এ নিয়ে তাদের আন্দোলন।

• খালিস্তান আন্দোলন কী?

ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চায় পাঞ্জাবের খালিস্তানপন্থী আন্দোলনকারীরা। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার আগে থেকে এই ধারণাটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। যদিও ওই বছর পাঞ্জাব অঞ্চলটি দুই দেশের মাঝে বিভক্ত হয়ে যায়।

পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে পাঞ্জাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে শিখ ধর্ম। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় আড়াই কোটি অনুসারী রয়েছে এই ধর্মের। শিখরা পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হলেও ভারতে সংখ্যালঘু। কারণ দেশটির ১৪০ কোটি মানুষের মাত্র ২ শতাংশ তারা।

শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের মাতৃভূমি ‘খালিস্তান’ বলে দাবি করেন। যার অর্থ ‘বিশুদ্ধ দেশ’। তারা চান, এই রাষ্ট্র পাঞ্জাবে গড়ে তোলা হোক।

অতীতে অনেকবার এই দাবি তুলেছিলেন শিখরা। ১৯৭০ এবং ১৯৮০’র দশকে সবচেয়ে সহিংস বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন তারা। শিখদের সহিংস ‍বিদ্রোহ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পাঞ্জাবকে পঙ্গু করে রেখেছিল।

• কীভাবে মোকাবিলা করছে ভারত?

খালিস্তান আন্দোলনকে ভারতের সরকার দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে মনে করে। শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে ভারতের সরকারি বাহিনীর সবচেয়ে রক্তাক্ত সংঘাতের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৪ সালে।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সন্ত জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়াল ও তার সমর্থকদের উচ্ছেদ করার জন্য শিখ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্রতম ‘স্বর্ণ মন্দিরে’ সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন; যা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিখদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।

এই ঘটনার কয়েক মাস পর নয়াদিল্লির বাড়িতে গান্ধীকে হত্যা করেন তার শিখ দেহরক্ষীরা। ভারতের সামরিক বাহিনী পাঞ্জাব থেকে শিখ বিদ্রোহীদের নির্মূল করার জন্য ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে অভিযান শুরু করে।

১৯৮৫ সালে কানাডা থেকে ভারতে আসা এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৪৭ বিমানে বোমা হামলার জন্যও শিখ বিদ্রোহীদের দায়ী করা হয়েছিল। আইরিশ উপকূলে এয়ার ইন্ডিয়ার ওই বিমান বিধ্বস্তে ৩২৯ আরোহীর সবাই নিহত হন।

শিখদের দীর্ঘদিনের বিদ্রোহে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং পাঞ্জাব এখনও সেই সহিংসতার ক্ষত বহন করছে। যদিও খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি ভারতে এখন খুব বেশি সমর্থন নেই। তবে কানাডায় শিখ প্রবাসীদের মাঝে তাদের বেশ শক্ত সমর্থন রয়েছে।

পাঞ্জাবের বাইরে শিখদের সর্বাধিক জনসংখ্যার বসবাস রয়েছে কানাডায়। এর বাইরে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিখদের বসবাস রয়েছে।

• ভারত এখন কেন চিন্তিত?

পুনরায় খালিস্তান আন্দোলন শুরু করার অভিযোগে চলতি বছরের এপ্রিলে ভারতের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী স্বঘোষিত প্রচারক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ নেতা অমৃতপাল সিংকে গ্রেপ্তার করে। শিখ এই নেতাকে গ্রেপ্তারের পর পাঞ্জাবে নতুন করে সহিংসতার শঙ্কা সৃষ্টি হয়।

পরে এই বছরের শুরুর দিকে ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এক অনুষ্ঠানে দৃশ্যায়নের অনুমতি দেওয়ার পর কানাডার তীব্র সমালোচনা করেছিল ভারত। এই দৃশ্যায়নকে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহিংসতায় কানাডা উসকানি দিয়েছে বলে মনে করা হয়।

সম্প্রতি কানাডা, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও তাদের সমর্থকদের ঘন ঘন বিক্ষোভ এবং ভাঙচুরের ঘটনা ভারতকে বিরক্ত করে তোলে। এসব দেশের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের কূটনৈতিক মিশনে আরও উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থার দাবি জানায় ভারত।

• ভারত-কানাডার সম্পর্কে কীভাবে প্রভাব ফেলছে এই আন্দোলন?

কানাডায় নিযুক্ত ভারতীয় কূটনীতিকরা বহুবার বলেছেন, ‘শিখ চরমপন্থা’ মোকাবিলায় অটোয়ার ব্যর্থতা, খালিস্তানিদের ভারতীয় কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের অব্যাহত হয়রানি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে অন্যতম প্রধান চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চলতি মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বৈঠক করেন। বৈঠকে কানাডায় শিখ বিক্ষোভের বিষয়ে ট্রুডোর কাছে দৃঢ় উদ্বেগ প্রকাশ করেন মোদি।

ভারতের সঙ্গে প্রস্তাবিত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা স্থগিত করেছে কানাডা। দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী মেরি এনজি ভারতে কানাডার প্রস্তাবিত বাণিজ্য মিশন স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন।

সূত্র: রয়টার্স।

এসএস