কেরালার কোঝিকোড জেলার একটি হাসপাতালের বাইরে ‘নিপাহ আইসোলেশন ওয়ার্ড, প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ’ লেখা সাইনবোর্ড বসাচ্ছেন কর্মীরা। ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ছবি: রয়টার্স

দুজনের প্রাণ কেড়ে নেওয়া বিরল ও ভয়াবহ প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাসের বাংলাদেশি ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার ঠেকাতে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায় কিছু স্কুল, অফিস এবং গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বুধবার রাজ্য সরকার নিপাহ ভাইরাসের বিস্তার রোধে সতর্কতামূলক এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে।

রাজ্যের এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেছেন, নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত এক শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক এক ব্যক্তি এখনও হাসপাতালে আছেন। এছাড়া আরও ১৩০ জনেরও বেশি মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়েছে।

সংক্রমিত বাদুড়, শূকর বা অন্যান্য প্রাণীর শরীর থেকে নিঃসৃত তরলের মাধ্যমে মানবদেহে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বীনা জর্জ বলেছেন, আমরা সংক্রমিতদের সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন তাদের শনাক্ত করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। যাদের উপসর্গ রয়েছে, তাদের আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে কেরালায় শনাক্ত হওয়া নিপাহ ভাইরাসটি বাংলাদেশি ভ্যারিয়েন্ট বলে জানিয়েছেন বীনা জর্জ। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশি এই ভ্যারিয়েন্ট মানুষ থেকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশি ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুর হার অনেক বেশি হলেও তা কম সংক্রামক।

• আরও পড়ুন: কেরালায় ‘বাংলাদেশি নিপাহ’ শনাক্তের দাবি ভারতের 

তিনি বলেন, চিকিৎসা ব্যবস্থায় যাতে কোনও ধরনের সংকট সৃষ্টি না হয়, সেজন্য রাজ্যের কিছু অংশে জনসাধারণের চলাচল সীমিত করা হয়েছে।

রাজ্যের কোঝিকোড জেলায় সম্প্রতি দুই ব্যক্তির যে ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ হয়েছে, তা নিপাহ ভাইরাসের কারণে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন জর্জ। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা পিটিআইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কেরালায় নিপাহ ভাইরাসে প্রথম মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে গত ৩০ আগস্ট। আর দ্বিতীয় রোগী মারা গেছেন ১১ সেপ্টেম্বর।

দুজনের প্রাণহানির পর কর্তৃপক্ষ কোঝিকোড জেলার অন্তত সাতটি গ্রামে ‘কন্টেনমেন্ট জোন’ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। ভাইরাসের বিস্তার রোধে কঠোর আইসোলেশন ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে। পাশাপাশি সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর চিকিৎসাকর্মীদেরও কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।

কেরালায় নিপাহ ভাইরাসের চলমান প্রাদুর্ভাবে প্রথম প্রাণ হারিয়েছেন মারুটোনকারা গ্রামের এক কলা ও অ্যারেকা নাট চাষী। ওই ব্যক্তির চলাফেরা ও অন্যান্য যেসব মানুষের সংস্পর্শে তিনি এসেছিলেন তা শনাক্ত করার কাজ করছেন রাজ্যের সরকারি কর্মকর্তারা। শারীরিক অবস্থার অবনিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই চাষী যেসব স্থানে গেছেন, সেসব স্থানও শনাক্ত করেছেন তারা।

নিপাহ ভাইরাসে মারা যাওয়া মারুটোনকারা গ্রামের ওই ব্যক্তির মেয়ে এবং শ্যালকও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে তারা হাসপাতালের একটি আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং প্রতিবেশীদেরও নিপাহ ভাইরাস পরীক্ষা করা হচ্ছে।

• আরও পড়ুন: ‘পরবর্তী মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতি নেই’

গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেরালার সরকারি এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন প্রথম মারা যাওয়া ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন দ্বিতীয় রোগী। পরে তিনিও মারা যান। কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে কোনও সম্পর্ক ছিল না।

ভারতের ভাইরাস গবেষণাবিষয়ক জাতীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ভাইরোলজি ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরাসহ কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি প্রতিনিধি দল বুধবার কেরালায় পৌঁছেছেন। তারা ওই রাজ্যে নিপাহ ভাইরাসের অধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচ্ছিন্ন গ্রামে ফলখেকো বাদুড়ের সংখ্যার বিষয়ে জানতে জরিপ পরিচালনা করবেন।

১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে শূকরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা খামারি এবং অন্যান্যদের শরীরে প্রথমবারের মতো এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্তভাবে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ সময় বাদুড়ের মলমূত্রের মাধ্যমে দূষিত খেজুরের রস পানের কারণে অনেকেই নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হন।

কেরালায় এই নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে চারবার নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ওই বছর ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় এই রাজ্যে প্রথম নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ওই সময় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ২৩ জনের মধ্যে প্রাণহানি ঘটে ২১ জনের। পরে ২০১৯ ও ২০২১ সালে কেরালায় আরও দুজনের প্রাণ যায় এই ভাইরাসে।

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের গত মে মাসের এক অনুসন্ধানে বাদুড়ের শরীর থেকে সৃষ্ট ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের জন্য বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে যেসব স্থান চিহ্নিত করা হয়, তার মধ্যে কেরালাও ছিল। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাপক বন উজাড় এবং নগরায়ন মানুষ ও বন্যপ্রাণীকে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে নিয়ে এসেছে।

নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তদের তীব্র শ্বাসকষ্ট, এনসেফালাইটিস, জ্বর, মাথা ধরা, পেশির যন্ত্রণা, বমি ভাব হতে পারে। এই ভাইরাসে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ হয়। ডব্লিউএইচও এই ভাইরাসটিকে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য বৃহত্তর হুমকি শনাক্ত করলেও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর এটি মোকাবিলায় কোনও প্রকল্পই নেই, বলছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা অ্যাকসেস টু মেডিসিন্স ফাউন্ডেশন।

সূত্র: রয়টার্স, পিটিআই, হিন্দুস্তান টাইমস।

এসএস