আগামী বছর জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করবে ব্রাজিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভার হাতে উপহার তুলে দেন।

দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত ‘দিল্লি ঘোষণাপত্র’কে ভারতের কূটনৈতিক বিজয় এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাব হিসাবে দেখা হচ্ছে।  
তবে সম্মেলনের কয়েকদিন আগেও এ ঘোষণাপত্র নিয়ে শঙ্কা ছিল। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে আগের সম্মেলনে রাশিয়ার বিষয়ে যে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছিল এবারও যদি তার ধারাবাহিকতা না থাকে তবে বেঁকে বসতে পারে পশ্চিমারা, একদিকে ছিল এমন শঙ্কা। অন্যদিকে ওই ধরনের ভাষা ব্যবহার করলে বেঁকে বসবে রাশিয়া।  

ভারত ইউক্রেন যুদ্ধের অত্যন্ত জটিল ইস্যু পাশে রেখেই একটি যৌথ বিবৃতি জারি করতে সক্ষম হয়েছে, যা ইউক্রেন ব্যতীত সব পক্ষ স্বাগত জানিয়েছে।

এ বিবৃতির সাতটি অনুচ্ছেদে ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। তবে কোথাও রাশিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়নি। 

তবে কেউ কেউ মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র এ ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে রাজি হওয়ার পেছনে এক ধরনের সমঝোতা রয়েছে। 

সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিশ্বের সব নেতার সঙ্গে  বেশ সাবলীলও দেখা যায়। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভের সঙ্গে তার ‘হাস্যোজ্জ্বল’ একটি ছবিও আসে।

বিশ্ব মিডিয়া তাদের প্রতিবেদনে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং জি-২০ সম্মেলনের সাফল্যের কথাও উল্লেখ করেছে।  

মার্কিন সংবাদ সংস্থা এনবিসি তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, জি-২০-তে ভারতের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাবের পাশাপাশি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগও দেখা গেছে।

দুদিনব্যাপী জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধানরা নয়াদিল্লিতে গিয়েছিলেন। সম্মেলন ঘিরে দিল্লি কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।

ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে তোলা মোদি ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ছবি নিয়ে আলোচনা চলছে।

 

এনবিসি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বের ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর এই বৈঠক কেবল ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবই দেখায়নি, দেশের হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের ক্রমবর্ধমান সমালোচনা, বিশেষত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও দেখিয়েছে।

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং আমেরিকার মিত্র। অন্যদিকে, ভারত পশ্চিমা দেশগুলো এবং রাশিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালন করেছে।

এনবিসি তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, ভারত বামপন্থী চীনের ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিপরীতে পাল্টা শক্তি। 

এনবিসি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে— সাংবাদিকদের সম্মেলনে আসা নেতাদের থেকে দূরে রাখা হয়েছে। নয়াদিল্লিতে পোস্টারে ভারত নিজেকে গণতন্ত্রের জননী ঘোষণা করেছে, কিন্তু সম্মেলনে শত শত সাংবাদিককে নেতাদের কাছ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। 

এনবিসি লিখেছে— শুক্রবার রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠক কভার করার অনুমতি দেওয়া হয়নি কোনো সাংবাদিককে।

সিএনএন তাদের প্রতিবেদনে রাশিয়ার নয়া দিল্লি ঘোষণাকে ‘সফল’ এবং এ নিয়ে ইউক্রেনের অসন্তোষের কথা উল্লেখ করেছে।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের বিবৃতিও প্রকাশ করেছে সিএনএন।

ঘোষণা প্রকাশের একদিন পর ল্যাভরভ বলেন, এই সম্মেলন শুধু ভারতের জন্যই নয়, আমাদের সবার জন্যই সফল হয়েছে। 

ইউক্রেন যুদ্ধ একটি জটিল ইস্যু এবং এটি সম্পর্কে পশ্চিমা, রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। 

সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়— এই বিবৃতি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি ‘গেম চেঞ্জার’ ছিল। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের নরম অবস্থানকেও প্রতিফলিত করে।

ভারতের জন্য বড় সাফল্য

ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, জি-২০ ঘোষণা ইউক্রেন নিয়ে ক্রমবর্ধমান মতপার্থক্য এবং গ্লোবাল সাউথের (ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশ) ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে প্রতিফলিত করে।

আফ্রিকান ইউনিয়নও জি-২০ সম্মেলনে এ গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, আয়োজক ভারত চূড়ান্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করার জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠীকে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছে, তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের বিতর্কিত ইস্যুতে ভাষা নরম করে এটি করা হয়েছে। 

ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগে শেষ মাসগুলোতেও ভারত ইউক্রেন যুদ্ধের ঘোষণাপত্রের কথায় একমত হতে পারেনি, কারণ চীন ও রাশিয়াও বালিতে ব্যবহৃত ভাষার বিপক্ষে ছিল।

শীর্ষ সম্মেলন শেষ হওয়ার একদিন আগে প্রকাশিত ঘোষণাপত্রে ‘ইউক্রেন যুদ্ধের মানবিক দুর্ভোগ এবং নেতিবাচক প্রভাবের’ কথা তুলে ধরা হয়েছিল। তবে এতেও রাশিয়ার নাম ছিল না। 

অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করেছিলেন যে জি-২০ সম্মেলনে একটি যৌথ বিবৃতি জারি করা কঠিন হবে। তবে সম্মেলনের প্রথম দিনেই দিল্লি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়।

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এই ঘোষণাকে ভারতীয় কূটনীতির সাফল্য বলে অভিহিত করেছেন।

ওলাফ বলেন, রাশিয়া তার প্রতিরোধ পরিত্যাগ করেছে এবং ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।

ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছে যে পশ্চিমা দেশগুলোও রাশিয়ার এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকে সাফল্য হিসেবে দেখছে।

লাভবান হবে মোদি ও বিজেপি : গ্লোবাল টাইমস

চীনের সরকারি সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমসও তাদের নিবন্ধে বলেছে, ক্রমবর্ধমান মতপার্থক্যের মধ্যে জি-২০ সম্মেলন মৌলিক সংহতি প্রদর্শন করতে পেরেছে।

গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অবশেষে একটি যৌথ বিবৃতি গৃহীত হয়, যাতে ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে মৌলিক সংহতি এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।

গ্লোবাল টাইমস লিখেছে, চীনা বিশ্লেষকরা বলছেন, জি-২০ এখন বৈশ্বিক শাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বহুপাক্ষিক প্রক্রিয়া, যদিও বড় শক্তিগুলোর মধ্যে জটিল দ্বন্দ্বের কারণে গ্রুপটি অকার্যকর হওয়ার ঝুঁকির মুখে রয়েছে। 

সম্মেলনে যোগ দিতে আসা চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াংয়ের বিবৃতিও প্রকাশ করেছে গ্লোবাল টাইমস।

শীর্ষ সম্মেলনে লি বলেন, জি-২০ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করা উচিত, সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে দিয়ে শুরু করা উচিত এবং বর্তমানে ভালো করার চেষ্টা করা উচিত। লি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উন্নয়ন এবং জি-২০ সদস্যদের উচিত উন্নয়নকে বৃহত্তর নীতি সমন্বয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা।

ফুদান ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক লি মিনওয়াং গ্লোবাল টাইমসকে বলেন, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সাফল্য ভারতে মোদি ও তার ভারতীয় জনতা পার্টির শাসনকে শক্তিশালী করবে।

গ্লোবাল টাইমস লিখেছে যে এই সম্মেলন থেকে ভারত অনেক কিছু অর্জন করেছে কারণ ভারত আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেকে ‘খুব আকর্ষণীয়’ করে তুলেছে। ভারত এমন একটি দেশ যার পিছনে রাশিয়া এবং পাশ্চাত্য উভয়ই রয়েছে।

গ্লোবাল টাইমস লিখেছে, ইউক্রেন সঙ্কটে উন্নয়নশীল দেশগুলো যে পশ্চিমা ও রাশিয়ার মধ্যে কোনো পক্ষ নিতে চায় না ভারত সেটারও প্রতিনিধিত্ব করে।  

বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে গ্লোবাল টাইমস আরও বলেছে যে ভারতের জাতীয় শক্তি এবং অর্থনীতি অবশ্য গ্লোবাল সাউথকে নেতৃত্ব দেওয়ার তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট বড় নয়।

মোদিকে কৃতিত্ব দেওয়াটা ন্যায়সঙ্গত হবে

পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দিল্লিতে জারি করা যৌথ ঘোষণা যদি ইউরোপে শান্তি বয়ে আনে, তাহলে এর কিছু কৃতিত্ব মোদির। তাকে এ কৃতিত্ব দেওয়া ন্যায়সঙ্গতও হবে।

এ মাসেই মোদির আহ্বানে ভারতীয় সংসদের একটি বিশেষ অধিবেশন শুরু হবে এবং তিনি এতে আরও বড় কিছু করতে পারেন। বিশ্বের প্রশংসার মধ্যে তিনি ইউক্রেনে শান্তির বার্তা পাঠিয়েছেন, কিন্তু মণিপুর ও কাশ্মীরসহ ভারতের বিস্তীর্ণ অংশের জনগণের দুর্দশা মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপের কোনো চিন্তা তার নেই।   

জার্মান সংবাদপত্র ডেইত জায়াতের বরাত দিয়ে রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস বলেছে, জি-২০ এর যৌথ বিবৃতি ইঙ্গিত দেয় যে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

জার্মান সংবাদপত্র ডেইত জায়াত তাদের নিবন্ধে বলেছে, রাশিয়ার সমালোচনা করে একটি অনুচ্ছেদেরও অনুপস্থিতি প্রমাণ করে যে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

এনএফ