জি-২০ সম্মেলন যে কায়দায় কাজে লাগালেন মোদি
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-২০ বা ‘গ্রুপ অব টোয়েন্টি’; যা ১৯৯৯ সালে এশিয়ান ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের পর প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল। তবে গোড়ার দিকে এই কুড়িটি দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররাই জোটে প্রতিনিধিত্ব করতেন।
পরে এই দেশগুলোর সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা জোটের মুখ হিসেবে দেখা দেন। আর ২০০৯ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজিত হতে থাকে। গত এক যুগেরও বেশি সময়ে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে লন্ডন, পিটসবার্গ থেকে হাংঝৌ, টরন্টো থেকে ব্রিসবেন কিংবা ওসাকা থেকে আন্তালায়া— বিশ্বের বহু শহরে এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
জোটের বর্তমান চেয়ার বা সভাপতি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে এই মুহূর্তে চলছে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দিল্লিতে না এসে প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। এছাড়া বিশ্বের সব উল্লেখযোগ্য বিশ্বনেতা জোটের বৈঠকে যোগ দিতে এই মুহূর্তে দিল্লিতে।
সম্মেলনের আয়োজনকে কেন্দ্র করে দিল্লি শহর যেরকম অপূর্ব সাজে সেজে উঠেছে এবং গোটা ভারতজুড়ে জি-২০-কে ঘিরে যে ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা প্রায় নজিরবিহীন।
পর্যবেক্ষকরা সবাই এক বাক্যে বলছেন, এর আগেও বহু দেশ জি-২০ ‘চেয়ার’ বা রোটেটিং প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব পেয়েছে। কিন্তু ভারতের মতো কেউই এতটা দক্ষতার সঙ্গে এই সুযোগ রাজনৈতিক বা কূটনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি।
একদিকে উন্নয়নশীল বিশ্ব বা ‘গ্লোবাল সাউথে’র নেতৃস্থানীয় কণ্ঠস্বর হিসেবে ভারত এর মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। অন্যদিকে দেশের ভেতরেও জি-২০ জোটের প্রেসিডেন্সির বিষয়ে জোরালো প্রচারণা চালিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, বিশ্বমঞ্চেও ভারতের গুরুত্ব ও মর্যাদা এখন আলাদা।
আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনে এই বিষয়টা নরেন্দ্র মোদিকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে বলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। সব মিলিয়ে জি-২০ সভাপতিত্বকে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার যেভাবে সদ্ব্যবহার করেছে; তার কোনও তুলনা আগেও কখনও দেখা যায়নি, পরেও কখনও হবে কি না সন্দেহ!
• ‘বিশ্বগুরু’ ভারত
নরেন্দ্র মোদি সরকার তাদের দ্বিতীয় মেয়াদের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসেবে তুলে ধরার কথা বলতে শুরু করেছিল। ভারতে কোভিড ভ্যাকসিন বানানো শুরু হওয়ার পর যখন বিভিন্ন দেশে তা রপ্তানি শুরু করে, তখনই এই শব্দবন্ধটির প্রচলন শুরু হয়।
বিশ্বগুরু বলতে বোঝানো হয়, যারা সারা দুনিয়ার মুর্শিদের কাজ করবে, পথ দেখাবে। গত নভেম্বরে জাকার্তায় জি-২০ সম্মেলনের পর যখন জোটের প্রেসিডেন্সি ভারতের হাতে আসে, তখন থেকেই বিশ্বগুরু শব্দটি দেশটিতে আলাদা একটি মাত্রা পায়।
গত বছরের শেষ দিক থেকেই ভারতের ছোট-বড় বিভিন্ন শহর ছেয়ে যায় জি-২০-এর বিশাল বিশাল পোস্টার ও ব্যানারে। যাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাস্যোজ্জ্বল মুখের বিশাল ছবির সঙ্গে তুলে ধরা হতে থাকে বিশ্বনেতাদের ছবি।
নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে সারা পৃথিবীর তাবড় নেতারা দিল্লিতে আসছেন ও এক মঞ্চে মিলিত হচ্ছেন, এই জিনিসটাকে দারুণ সফলভাবে বিজ্ঞাপন করা হতে থাকে। দিল্লিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজেশ চতুর্বেদীর কথায়, ‘তখন থেকেই নরেন্দ্র মোদি আর বিশ্বগুরু কনসেপ্ট কিন্তু একাকার হয়ে গেছে!’
‘সরকার গত এক বছর ধরে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করে গেছে মোদিই বিশ্বগুরু, কিংবা বিশ্বগুরুই মোদি। মানুষ সেটা অনেকটা বিশ্বাসও করেছে’, বিবিসিকে বলছিলেন চতুর্বেদী।
সারা বছর জি-২০ জোটের বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক যেহেতু ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজন করা হতে থাকে, সেই সিদ্ধান্তটাও এই ভাবনাকে দেশময় ছড়িয়ে দিতে খুব সাহায্য করেছিল। এমনকি জোটের পর্যটন গ্রুপের একটি বৈঠক ফেলা হয়েছিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরের শ্রীনগরেও, যার মাধ্যমে ভারত এটাই দেখাতে চেয়েছিল যে আন্তর্জাতিক বিশ্বও এখন স্বীকার করে কাশ্মীর কোনও বিতর্কিত ভূখণ্ড নয়; বরং ভারতেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ফলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের প্রভাব-প্রতিপত্তি যে অনেক বেড়েছে, দেশের সাধারণ মানুষও সে কথা এখন বিশ্বাস করছেন।
মার্কিন গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চের সাম্প্রতিক এক জরিপেও এই বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে। যেখানে দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ ভারতীয় এখন বিশ্বাস করেন বিশ্বমঞ্চে ভারতের মর্যাদা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
আমজনতার এই ‘ফিল গুড’ ফ্যাক্টর ও জাতীয়তাবাদী গর্ববোধ মাস কয়েক পরের সাধারণ নির্বাচনেও নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা এনে দিতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন।
• ‘গ্লোবাল সাউথে’র কণ্ঠস্বর
ভারতের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ চলতি সপ্তাহে একটি নিবন্ধের শিরোনাম করেছে ‘রিসাউন্ডিং সাকসেস অব ইন্ডিয়া’, অর্থাৎ ভারতের অভূতপূর্ব সাফল্য!
তারা বলছে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল ফোকাস ছিল দুনিয়ার গরিব দেশগুলো, যাকে সাধারণভাবে ‘তৃতীয় বিশ্ব’ বলা হত। কিন্তু ভারত এখন বিশ্বের উদীয়মান ও স্বল্পোন্নত অর্থনীতি দেশগুলোর প্রতিভূ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাইছে এবং সেই লক্ষ্যে জি-২০ জোটের প্রেসিডেন্সি তাদের খুবই সাহায্য করেছে।
চলতি বছরের গোড়ার দিকে বিশ্বের এ ধরনের ১২৫টি দেশকে নিয়ে ভারত একটি ‘গ্লোবাল সাউথ’ সামিটেরও আয়োজন করেছিল। যেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভাষণ দিয়েছিলেন।
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ মনে করছে, জি-২০ সম্মেলনের পর এই গ্লোবাল সাউথের নেতৃস্থানীয় কণ্ঠস্বর হিসেবে ভারত উঠে আসতে পারবে। বিশেষত দিল্লির সম্মেলনে যেহেতু ভারতের উদ্যোগেই আফ্রিকান ইউনিয়নকে (এইউ) জি-টোয়েন্টি জোটের নতুন সদস্য হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই ওই মহাদেশেও ভারতের গুরুত্ব বাড়বে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।
সিএনএন লিখেছে, জি-২০ আসলেই ‘মোদির জন্য ঝলসে ওঠার একটা চমৎকার সুযোগ!’
তাদের মতে, নরেন্দ্র মোদি যেভাবে ভারতকে ‘আধুনিক সুপারপাওয়ার’ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন, সেখানে প্রথমে ভারতের চন্দ্রযান-৩ এর সাফল্য এবং তার পরপরই একটি বিশাল মাপের আন্তর্জাতিক সম্মেলন সফলভাবে করে দেখানো খুবই সাহায্য করবে।
ভারত চলতি বছরেই বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চীনকে ছাপিয়ে গেছে। এছাড়া বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারতেই প্রবৃদ্ধির হার এখন সবচেয়ে বেশি। ঠিক এই সময়ে জি-২০ জোটের প্রেসিডেন্সির পদ ভারতের জন্য দারুণ একটা সুযোগ হয়ে এসেছিল; যেটাকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগানো হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন।
• ঐকমত্য গড়ায় সাফল্য
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজনে ভারতের কাছে সম্ভবত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সদস্য দেশগুলোর সবার সম্মতিক্রমে একটি ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ (দিল্লি ডিক্লারেশন) জারি করা।
গত এক বছর ধরে জোটের বিভিন্ন বৈঠকেই দেখা গেছে ইউক্রেন সঙ্কট বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ইস্যুতে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মতবিরোধের কারণে কোনও সর্বসম্মত বিবৃতি দেওয়া যায়নি। বেশিরভাগ বৈঠকের পরই যেটা জারি করা হতো তাকে ‘আউটকাম ডকুমেন্ট’ বলা হয়েছিল; তাতে যেমন কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেটা বলা থাকত, তেমনি কারা কোথায় আপত্তি জানিয়েছে সেটাও উল্লেখ থাকত।
কিন্তু শনিবার সন্ধ্যায় দিল্লির ‘ভারত মন্ডপম’ সভাস্থল থেকে যেহেতু শতভাগ সর্বসম্মতির ভিত্তিতে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করা সম্ভব হয়েছে; তাই দেখা যাচ্ছে ঐকমত্য গড়ার সেই কঠিন পরীক্ষাতেও ভারত উতরে গেছে।
দিল্লির অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থ বিবিসিকে বলছিলেন, বৈশ্বিক রাজনীতিতে ফল্টলাইনগুলো এখন এতটাই প্রকট যে দিল্লিতে যদি কোনও যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করা সম্ভব নাও হতো তাহলেও ভারতকে দোষ দেওয়া যেত না।
কিন্তু তারপরও যে রাশিয়া, চীন, আমেরিকা বা ব্রিটেনের মতো দেশগুলোকে কাছাকাছি এনে একটা ঘোষণাপত্রে ভারত সবাইকে রাজি করাতে পেরেছে সেটাকে তিনি ‘বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য’ হিসেবেই দেখতে চান।
ভারতের আরেক বিখ্যাত থিঙ্কট্যাঙ্ক তক্ষশীলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক কাজরী কমলও মনে করেন, আন্তর্জাতিক স্তরে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ভারতের মুন্সিয়ানারই প্রমাণ দিল এই জি-টোয়েন্টি সম্মেলন। বিশ্বের ইস্ট আর ওয়েস্ট (পূর্ব ও পশ্চিম), কিংবা হালের নর্থ ও সাউথের (উত্তর ও দক্ষিণ) মধ্যে সেতুবন্ধনের কঠিন কাজটা যে ভারত করে দেখাতে পারছে, আমি মনে করি সেটাই এই সম্মেলন থেকে তাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।
জি-২০ সম্মেলনের আয়োজনকে ভারতের ইতিহাসে একটি মাইলফলক করে তুলতে নরেন্দ্র মোদি কোনও চেষ্টাই বাকি রাখেননি। এখন এই সম্মেলন তাকে দেশের ইতিহাসে কীভাবে জায়গা করে দেয়, দেখার বিষয় সেটাই। বিবিসি বাংলা।
এসএস