দুই মাস আগে ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া রাশিয়ার ভাড়াটে সামরিক বাহিনী ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন বুধবার বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। রুশ কর্মকর্তারা বলেছেন, বুধবার ওয়াগনার প্রধানসহ ১০ আরোহীকে নিয়ে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানের কেউই বেঁচে নেই। গত ২৩ জুনের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ওয়াগনার সৈন্যরা রাশিয়ার পিঠে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে বলে মন্তব্য করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যে কারণে কীভাবে এই বিমান দুর্ঘটনা ঘটল, আর এটি নিছকই দুর্ঘটনা নাকি অভ্যুত্থানের প্রতিশোধ নিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

রাশিয়ার বেসামরিক বিমান সংস্থা বলেছে, মস্কোর উত্তর-পশ্চিমে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে এবং বিমানে থাকা সব আরোহী নিহত হয়েছেন।  ভাড়াটে সামরিক বাহিনী ওয়াগনারের প্রধান প্রিগোজিনও বিধ্বস্ত বিমানে ছিলেন। ইউক্রেন যুদ্ধে নৃশংস অভিযান আর সাফল্যের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন ওয়াগনারের এই প্রধান।

• আসলে কী ঘটেছিল বিমানে?

রাশিয়ার বেসরকারি বিমান পরিচালনা সংস্থা এমব্রায়ারের ওই বিমানে সাতজন আরোহী ও তিনজন ক্রু সদস্য ছিলেন বলে জানিয়েছে দেশটির জরুরি সেবাবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

রুশ কর্মকর্তারা বলেছেন, বিমানটি মস্কো থেকে উড্ডয়ন করে সেন্ট পিটার্সবার্গে যাওয়ার পথে রাশিয়ার পশ্চিমের তেভার অঞ্চলের কুজেনকিনো গ্রামের কাছে বিধ্বস্ত হয়েছে। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডাটায় দেখা যায়, বিমানটি প্রায় ২৮ হাজার ফুট উচ্চতায় পৌঁছেছিল। এরপরই হঠাৎ করে ফ্লাইট ট্র্যাকিংয়ের বিস্তারিত তথ্য পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাসের তথ্য বলছে, দুর্ঘটনাস্থলে আটজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। বিধ্বস্ত হওয়ার পর বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। এতে বিমানটি পুড়ে গেছে। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে আকাশে উড়ছিল বিমানটি।

বৃহস্পতিবার দেশটির আরেক সরকারি সংবাদমাধ্যম রাশিয়া-২৪ বলেছে, ‘বিধ্বস্ত হওয়ার পর এমব্রায়ারের ওই বিমানের ধ্বংসাবশেষ (কুজেনকিনো) গ্রাম থেকে ২ কিলোমিটার দূরেও পাওয়া যায়। বিমানের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বিমানটির বেশিরভাগ ধ্বংসাবশেষ কৃষি জমিতে পাওয়া গেছে।

রুশ বার্তা সংস্থা আরআইএ নভোস্তিও বলেছে, বিমানের ধ্বংসাবশেষের একটি টুকরা কুজেনকিনো গ্রামে ঢোকার রাস্তায় পড়ে ছিল। ওই এলাকাটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। এর আশপাশে দেশটির বিশেষ পরিষেবা সংস্থার কয়েকটি গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়েছে।

আরআইএ নভোস্তির প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, বিমানটির একটি ডানা নেই। সিএনএন ভিডিওটির সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি। এমব্রায়ারের বিমানটি আকাশ থেকে তেভার অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়েছে বলে আরআইএ নভোস্তি দাবি করেছে।

তবে বিমানটি কী কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। রুশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা বিমান বিধ্বস্তের এই ঘটনা তদন্ত করছে এবং তল্লাশি শেষ হয়েছে।

বিমানটির বিধ্বস্ত হওয়ার ফুটেজ পর্যালোচনা করার পর বিজ্ঞান ও মহাকাশবিষয়ক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাইলস ও’ব্রায়েন সিএনএনকে বলেছেন, বিমানটি দ্রুতগতিতে ঘুরপাক খেতে খেতে নেমেছে। এটি থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হচ্ছিল। সুতরাং এতে মনে হচ্ছে বিমানটি আগুনে পুড়েছে এবং বিমানটির কিছু অংশ অনুপস্থিত ছিল।

তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে এ ধরনের একটি বিমান এমন ভয়ঙ্করভাবে আকাশ থেকে পড়ে যায় না।’ মাইলস ও’ব্রায়েন বলেন, এটি বিমানের ভেতরে বা বাইরে বিস্ফোরণের কারণে হতে পারে। বিমানটির শরীরে বিস্ফোরক অথবা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের কারণেও এটি ঘটতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক নিরাপত্তা পরিদর্শক ডেভিড সুসি একই ধরনের শঙ্কার কথা জানিয়ে বলেছেন, বিমানের পতন দেখে মনে হচ্ছে, এর মাত্র একটি ডানা ছিল।

• প্রিগোজিন কি বিমানে ছিলেন?

রাশিয়ার বেসামরিক বিমান সংস্থার প্রকাশিত যাত্রী তালিকায় প্রিগোজিন এবং ওয়াগনারের কয়েকজন শীর্ষ লেফটেন্যান্টের নাম আছে।

ওয়াগনারের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি টেলিগ্রাম চ্যানেল এর আগে বাহিনীটির প্রচারণামূলক ভিডিও প্রকাশ করেছিল। এই চ্যানেলের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রিগোজিনকে হত্যা করা হয়েছে। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি।

প্রিগোজিনের নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলসহ ওয়াগনারের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য চ্যানেলে এখনও এই বিষয়ে নীরব রয়েছে। আরআইএ নভোস্তির প্রকাশিত অপর এক ভিডিওতে বিমানটির বিধ্বস্ত হওয়ার স্থানে ধ্বংসাবশেষের মাঝে এর রেজিস্ট্রেশনের শেষ চারটি নাম্বার (২৭৯৫) দেখা যায়। আর প্রিগোজিনের ব্যক্তিগত বিমানের রেজিস্ট্রেশন নাম্বারও একই (আরএ-০২৭৯৫)।

• প্রতিশোধ নিলেন পুতিন?

রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রিগোজিনের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার ঠিক দুই মাস পর বুধবার (২৩ আগস্ট) বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। গত ২৩ জুন প্রিগোজিন ও তার ওয়াগনার সৈন্যরা কয়েকটি সামরিক স্থাপনা দখলে নেওয়ার পর মস্কোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ওই দিন মস্কোর রাস্তায় ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদের মোতায়েন করে ক্রেমলিন। কিন্তু সেখানে মুখোমুখি হওয়ার আগেই ওয়াগনার প্রধানের সাথে একটি চুক্তিতে পৌঁছায় মস্কো। চুক্তি অনুযায়ী, প্রিগোজিন ও ওয়াগনার যোদ্ধাদের প্রতিবেশি বেলারুশে পাঠানোর শর্তে অভ্যুত্থানের অবসান ঘটে।

ওয়াগনারের এই অভ্যুত্থানকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের গত ২৩ বছরের শাসনের মেয়াদে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। তবে একই সঙ্গে বিদ্রোহের পর কিছু বিশেষজ্ঞ অনুমান করেছিলেন, যুদ্ধবাজ প্রিগোজিনের যেকোনও সময় মৃত্যু হতে পারে। তারা বলেছিলেন, একজন মৃত মানুষ হাঁটছেন।

এমনকি বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই বিমান দুর্ঘটনায় পুতিন জড়িত থাকতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমি জানি না আসলে কী ঘটেছে। তবে আমি বিস্মিত নই।

সিআইএর পরিচালক বিল বার্নস এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। পুতিনের দীর্ঘদিনের প্রতিশোধ নেওয়ার ইতিহাস ও রুশ সমালোচক বা ভিন্নমতাবলম্বীদের রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মারা যাওয়ার কথা বলেছেন তারা।

রাশিয়ার সাবেক সর্ববৃহৎ বিদেশি বিনিয়োগকারী ও পুতিনের কট্টর সমালোচক বিল ব্রাউডার। রুশ প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করার কারণে দেশ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃত হওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, বিদ্রোহের পর প্রিগোজিন এতদিন বেঁচে থাকায় তিনি বিস্মিত ছিলেন। ওয়াগনারের অন্যান্য নেতা ও প্রিগোজিনের মিত্রদের হয়ত এখন পালিয়ে যেতে অথবা আত্মগোপনে থাকতে হবে।

• এখন কী ঘটবে?

রাশিয়ার সরকারি তদন্ত কমিটির মতে, দেশটির ফৌজদারি অপরাধ আইনের ২৬৩ ধারার আওতায় দুর্ঘটনার কারণ জানতে ফৌজদারি তদন্ত শুরু হয়েছে। এই আইনে দেশটিতে যান চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও বিমান পরিচালনা করা হয়।

রুশ জরুরি পরিষেবা সংস্থাগুলো বিমান বিধ্বস্তের স্থানে তল্লাশি শেষ করেছে। তেভার অঞ্চলের গভর্নর ইগোর রুদেনিয়া তদন্ত কাজের নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানা গেছে।

সূত্র: সিএনএন, বিবিসি।

এসএস