বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকাকে কি কোনও বার্তা দিয়েছে ভারত?
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস জোটের যে শীর্ষ সম্মেলন মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) থেকে শুরু হতে যাচ্ছে তার অবকাশে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে কি না তা এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে কোনও বৈঠক হচ্ছে কি না, এ ব্যাপারে এক নির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াতরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস সামিটের অবকাশে কোন কোন দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তার কিছুই এখনও চূড়ান্ত হয়নি। হলেই সেটা আপনারা জানতে পারবেন।
বিজ্ঞাপন
ব্রিকসের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে নতুন সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রার্থিতাকে ভারত সমর্থন করবে কি না, এই প্রশ্নের জবাবও কোয়াতরা এড়িয়ে গেছেন। পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অপর একটি সূত্র ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরসূচি এতটাই ঠাসা যে তাতে খুব বেশি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের জায়গা করার সুযোগ হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার বিকেলে জোহানেসবার্গে পৌঁছনোর পর প্রধানমন্ত্রী মোদি পুরো আড়াই দিন সেখানে থাকবেন। তারপরও সামিটের ফাঁকে তার আলাদা এই ‘বাইল্যাটারাল’গুলো অ্যকোমোডেট করতে আমরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি।
ভারতীয় কর্মকর্তারা সেই সঙ্গেই আভাস দিচ্ছেন, জোহানেসবার্গে একান্ত সম্ভব না হলে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে শেখ হাসিনা দিল্লিতে আসবেন তখন দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলাদা বৈঠকের সম্ভাবনা থাকবে।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত অর্থনৈতিক জোট ‘ব্রিকসে’ বাংলাদেশ যে নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দিতে ইচ্ছুক, সে কথা ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে ঢাকা।
কিন্তু ব্রিকসের সম্প্রসারণ নিয়ে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভারতের অবস্থান ঠিক কী, সেটা নিয়ে আস্তিনের সব তাস তারা এখনও বের করেনি। এমনকি কোন কোন দেশকে তারা সমর্থন করবে সেটাও এখনও জানায়নি।
এই পটভূমিতে জোহানেসবার্গে হাসিনা-মোদি বৈঠক হলে সেটা বাংলাদেশের প্রার্থিতার সমর্থনে অবশ্যই ভারতের পাশে থাকার বার্তা দেবে। কিন্তু কোনও কারণে সেই বৈঠক সম্ভব না হলে সেটাকে ঢাকার জন্য একটা ‘কূটনৈতিক হোঁচট’ হিসেবে দেখা হতে পারে।
• ব্রিকসের সম্প্রসারণ বিতর্ক
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের ‘শোকের মাস’ আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচরাচর কোনও বিদেশ সফরে যান না। কিন্তু এবারে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিতব্য ব্রিকস সামিটের জন্য তিনি সেই রীতির ব্যতিক্রম ঘটাতে রাজি হয়েছেন। কারণ ব্রিকসে নতুন সদস্য হিসেবে যোগদানের সম্ভাবনাকে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।
ব্রিকস জোটের বর্তমান চেয়ার, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামফোসার আমন্ত্রণেই তার এই সফর। মাস কয়েক আগে জেনেভাতে প্রেসিডেন্ট রামাফোসার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনাতেই প্রথম ওই জোটে বাংলাদেশের যোগদান নিয়ে কথা হয়েছিল।
অন্যদিকে জোহানেসবার্গের শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রথমে ‘ভার্চ্যুয়ালি’ যোগ দেবেন বলে কথাবার্তা চললেও পরে তিনি ‘ইন পার্সন’ যাবেন বলেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। বস্তুত শেখ হাসিনার মতোই নরেন্দ্র মোদিও মঙ্গলবার দক্ষিণ আফ্রিকায় পা রাখছেন।
এই পটভূমিতে আজ দিল্লিতে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের বিশেষ ব্রিফিংয়ে বিবিসি বাংলার তরফে জানতে চাওয়া হয়েছিল, জোহানেসবার্গে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলাদা কোনও বৈঠক হচ্ছে কি না? আর ব্রিকসে বাংলাদেশের প্রার্থিতাকে ভারত সমর্থন করছে কি না?
জবাবে পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কোয়াতরা বলেন, আপনারা জানেন বিশ্বের অনেক দেশের নেতারাই দক্ষিণ আফ্রিকায় উপস্থিত থাকবেন। আয়োজক দেশ (দক্ষিণ আফ্রিকা) আমাদের জানিয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেখানে থাকতে পারেন।
কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী সামিটের অবকাশে তাদের মধ্যে কার কার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করতে পারবেন, সেটা নিয়ে এখনও আলাপ-আলোচনা চলছে। এটা যখনই চূড়ান্ত হয়ে যাবে তখনই আমরা আপনাদের জানিয়ে দেব, বলেন কোয়াতরা।
যে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ভারত ‘সোনালি অধ্যায়’ বলে বর্ণনা করে থাকে, তাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের নিশ্চয়তা দিতে না পারাটা কিছুটা অস্বাভাবিক বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। তাদের অনেকেরই ধারণা, ব্রিকসে নতুন সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের ‘ক্যান্ডিডেচার’ বা প্রার্থিতা নিয়ে ভারতের দ্বিধাদ্বন্দ্বই এর কারণ।
ব্রিকসের সম্প্রসারণ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অবস্থান হল, ‘আমরা জোটে নতুন সদস্যদের যোগদানের বিরুদ্ধে নই, বরং বিষয়টাকে আমরা খোলা মনে ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই দেখছি। কিন্তু যোগদানের ‘মাপকাঠি’ কী হবে, সেটাও দেখতে হবে।’
অন্যভাবে বললে, ব্রিকসে চীন বা রাশিয়া তাদের প্রভাব বলয়ে থাকা বা তাদের বন্ধু দেশগুলোকে বেশি বেশি করে ঢুকিয়ে জোটের ‘ভারসাম্য যাতে বিঘ্নিত করতে না পারে’ ভারত সে ব্যাপারে খুবই সতর্ক ও সাবধানী থাকতে চাইছে।
ফলে প্রায় ৪০টির মতো দেশ এখন ব্রিকসে ঢুকতে চাইলেও ভারত তাদের কারও প্রতিই প্রকাশ্যে সমর্থন ব্যক্ত করেনি। তবে দুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও ইরানের প্রেসিডেন্টের মধ্যে ব্রিকসের সম্প্রসারণ নিয়ে টেলিফোনে কথা হয়েছে।
কিন্তু নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দিতে চেয়ে বাংলাদেশের আবেদনকে ভারত সমর্থন করবে কি না, কোয়াতরা বিবিসির এই নির্দিষ্ট প্রশ্নেরও কোনও জবাব দেননি।
• আমেরিকাকে কি বার্তা দেওয়া হয়েছে?
গত কয়েকদিনে দেশ-বিদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে এই মর্মে খবর বেরিয়েছে যে, বাংলাদেশে আমেরিকার ভিসা-নীতি ও কূটনৈতিক সক্রিয়তা নিয়ে ভারত তাদের আপত্তির কথা ওয়াশিংটনকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে।
তবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাংবাদিক সম্মেলনেও এ প্রসঙ্গে কোনও শব্দ খরচ করা হয়নি।
আজ বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র সচিবের ব্রিফিংয়ে নির্দিষ্টভাবে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এই ইস্যুতে ভারতের প্রকৃত অবস্থানটা ঠিক কী?
পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াতরা কোনও জবাব দেওয়ার আগেই মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী নিজের মাইক অন করে বলেন, আমি এই শেষের প্রশ্নটা নিয়ে বলব এগুলো কিন্তু আসলে প্রায় তাত্ত্বিক বা কাল্পনিক বিষয়। এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক হবে কি না, বা যদি হয় সেখানে এই বিষয়গুলো আসবে কি না তা তো এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে জানি না পররাষ্ট্রসচিব এটা নিয়ে কিছু বলতে চাইবেন কি না!
বিনয় মোহন কোয়াতরা অবশ্য তার জবাবে এ প্রসঙ্গে নতুন কিছু আর যোগ করেনি। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই বিবিসিকে আভাস দিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য আমেরিকার ভিসানীতি বা অন্যান্য পদক্ষেপ নিয়ে তারা প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন।
‘এটা আমাদের একটি বন্ধু প্রতিবেশী দেশকে নিয়ে তৃতীয় আর একটি দেশের বিষয়। সেটা নিয়ে আমরা কেনই বা বলতে যাব?’ জানান তারা। তবে এটা ঠিকই, আমেরিকাকে সত্যিই কোনও বার্তা দেওয়া হয়েছে, এটা যেমন ভারত স্বীকার করেনি, তেমনি আবার অস্বীকারও করেনি।
এসএস