ছাত্রের মৃত্যুতে উত্তাল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, অভিযোগ র্যাগিংয়ের
সম্প্রতি কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হোস্টেলের তিনতলা থেকে পড়ে গিয়ে স্বপ্নদীপ কুণ্ডু নামে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়। প্রথম বর্ষের স্বপ্নদীপের ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’কে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়া এ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে ক্লাস বয়কট করছেন শিক্ষকরা।
বুধবার (৯ আগস্ট) মাঝ রাতে তার এমন মৃত্যুর খবরে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তার পরিবারসহ সহপাঠীরা। হোস্টেলে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করছে তার পরিবারের সদস্যরা। এ অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার (১১ আগস্ট) খুনের মামলা রুজু করে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বিজ্ঞাপন
এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পাশাপাশি পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, মূলত ভয়ের কারণেই প্রকাশ্যে কোনো প্রকার অভিযোগ আনেন না হোস্টেলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা। তাই হোস্টেলগুলোতে ঠিক কীভাবে র্যাগিং চলছে, সে বিষয়ে তারা কিছু জানতেও পারেন না।
ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কড়া আইন অনুযায়ী র্যাগিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের পাশাপাশি অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যেন তিনি ভর্তি না হতে পারেন, সেই শাস্তিরও বিধান রয়েছে।
যেভাবে মৃত্যু হয় স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর
স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর বাড়ি নদীয়া জেলার বগুলা এলাকায়। তার পরিবারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, গত রোববার তাকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে রেখে আসা হয়েছিল। তিনি দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝোঁকের কারণে বাংলা অনার্স পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে স্বপ্নদীপের মামা অরূপ কুণ্ডু জানান, প্রথম তিনদিন তিনি ক্লাস করেছিলেন, কিন্তু বুধবার রাতে তিনি বাড়িতে ফোন করে জানান তার খুব ভয় হচ্ছে, বাবা-মা এসে যেন দ্রুত তাকে নিয়ে যান। তার মাকে ফোনে জানিয়েছিলেন অনেক কিছু বলার আছে তার। এসময় তার বাবা-মা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, একটা রাত কোনোমতে কাটিয়ে দিতে। পরেরদিন সকালেই তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবেন তারা। তবে এরপর শত চেষ্টা করেও স্বপ্নদীপের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পারেননি তারা। রাতে হঠাৎ হোস্টেলের এক সিনিয়র তার বাড়িতে ফোন করে জানান, তিনতলা থেকে পড়ে গেছেন স্বপ্নদীপ। তবে হোস্টেলের কর্তৃপক্ষ একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাকে নিয়ে গেলে বৃহস্পতিবার ভোরে মৃত্যু হয় তার।
স্বপ্নদীপের বাবা রামপ্রসাদ কুণ্ডু পুলিশকে জানান, হোস্টেলের কিছু শিক্ষার্থীরা তার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী। পুলিশ বলছে তারা হোস্টেলের কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং শুক্রবার রাতে এক শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলেই মারাত্মক র্যাগিং হয় বলে অভিযোগ উঠছে। ভূবিজ্ঞান বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া অর্পণ মাঝি নামে প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট করে অভিযোগ করেন। তিনি স্বপ্নদীপের সঙ্গে একই হোস্টেলে থাকতেন, তবে দুইজনের বিষয় ছিল আলাদা।
অর্পণ মাঝি সেখানে লেখেন, আমার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা একটি পরিবার এবং আমি আসানসোলে বড় হয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই আমি ভর্তির সময় হোস্টেলে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। জীবনে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার পর দুই/তিন রাত হোস্টেলটি আমার কাছে বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে। আমি এখন অনেক কষ্ট করে ধার নিয়ে হলেও মেস খুঁজছি। সমাজের প্রতিটি স্তরে ক্ষমতা প্রদর্শন আছে, কিন্তু যাদবপুর মেইন হোস্টেলের কিছু দাদাও যে এ একই কাজ করবেন, তা আমার কল্পনার অতীত। মাথায় একটি স্পেসিফিক ছাঁটের চুল কাটতে বলা, সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হোস্টেলে ঢুকতেই হবে, সিনিয়রদের ক্রমাগত ফাইফরমাশ খাটা, সারারাত জাগিয়ে রেখে ইন্ট্রো নেওয়া (শুনতে পারছি যে এখনও আসল ইন্ট্রো নেওয়াই হয়নি)। এগুলো ওই তিনরাত আমার সাথে চলছে এবং আমি ভীত!
অর্পণ মাঝির এ পোস্টের পর একে একে আরও কয়েকজন বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও ছাত্রী আবাসগুলোতে র্যাগিংয়ের নামে কি ধরনের মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার চলে, তার বর্ণনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করতে শুরু করেন।
সায়ন নামের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী লেখেন, খাওয়া দাওয়া মিটলে, আমার রুমমেট তথা এক বছরের সিনিয়র এক ইঞ্জিনিয়ারিং এর দাদার ওপর নির্দেশ আসে আমাকে ইন্ট্রো সম্পর্কে বুঝিয়ে দিতে। ইন্ট্রো সে যা বোঝায়, সেই অনুযায়ী, প্রতিদিন রাত ১১টা বা ১২টার পর অত্যন্ত স্বল্প-বসনে বিল্ডিং এর একটি একটি করে দরজা নক করতে হবে আমাকে। তারপর ওই ঘরের সিনিয়ররা দরজা খুললে সাবধান পজিশনে দাঁড়িয়ে একটি ফরম্যাট মুখস্থ বলতে হবে। সেটি শুরু হবে আমার নাম, বাবার নাম, মার নাম দিয়ে। তারপর জন্মদিবস। তারপর আনুমানিক প্রতিষ্ঠা দিবস (আমার জন্মের সময়ের ৯ মাস ১০ দিন আগের দিনটি হলো এ দিনটি; আশা করি সবাই ইঙ্গিতটি বুঝতে পারছেন)। তারপর প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চতর মাধ্যমিকের গোটা সিভি। এ ফরম্যাটটি শেষ হবে শারীরিক বর্ণনায়। পুরো বক্তব্যে একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলে হয় উঠবস, নয় খিলের আঘাত সহ্য করতে হবে হাঁটুর পেছনে। এ ইন্ট্রোটি চলবে রাত আড়াইটা পর্যন্ত। এটি কতদিন দিতে হবে? হোস্টেলের জনৈক সিনিয়রের কথায় যতদিন না আমার পুরুষাঙ্গের দৈর্ঘ্যটি পর্যন্ত সমস্ত আবাসিক ছাত্রের মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত। এছাড়া সপ্তাহে একদিন সব ঘরের সব সিনিয়রের পানির বোতলে পানি ভরে দিতে হবে। চুলে থাকবে মিলিটারি ছাঁট। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হোস্টেলে ঢুকে যেতে হবে এবং ক্লাসের সমস্ত মামণির গল্প তাদের বলতে হবে। পরদিন সন্ধ্যায় আমি হোস্টেল ছাড়ি এ বুঝে যে, এসব আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে না। বাবার আর্থিক সঙ্গতি বিশেষ না থাকলেও যে করে হোক, যত কষ্টেই হোক একটি মেস/পিজি খুঁজতে হবে আমাকে।
এদিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী-আবাসেও র্যাগিং সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তাদের লেখা ওইসব বর্ণনায় যা উঠে এসেছে, তা যৌন হেনস্থার সামিল বলে মনে করছেন দেশটির আইনজীবীরা।
এ প্রসঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চ্যাটার্জী বলেন, যেভাবেই র্যাগিং করা হয়ে থাক, তা ২০০০ সালে পাশ হওয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি আইন অনুযায়ী অপরাধ এবং এর জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের সাজা হতে পারে। ভর্তির সময়ে পড়ুয়া এবং তার অভিভাবকদের একটা ফর্ম পূরণ করা বাধ্যতামূলক যে, ওই ছাত্র বা ছাত্রী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে র্যাগিং-এ যুক্ত থাকবেন না। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো স্থান, ক্যাম্পাস, হোস্টেল, মেসসহ যেকোনো জায়গাতেই র্যাগিং বেআইনি আর এরকম ঘটলে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিও দায়ী থাকবেন। এমন যেকোনো ধরনের কাজ- যা ছাত্র বা ছাত্রীরা সাধারণভাবে করতে ইচ্ছুক না, তাকে যদি সেটা করতে বাধ্য করা হয়, সেটাই আইন অনুযায়ী র্যাগিং। কিন্তু এ ঘটনাটি আর র্যাগিং দমন আইনের আওতায় নেই। এখানে একটি ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির আওতায় এর তদন্ত হবে যে এটি খুন, না অনিচ্ছাকৃত হত্যা অথবা আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার ঘটনা।
তিনি বলেন, এ ধরণের ঘটনা যারা ঘটাতে পারেন, তারা পাষণ্ড। এদের সমাজে ছেড়ে রাখা একেবারেই অনুচিত। এরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে হয়তো বিদেশে চলে যাবেন। আমি তো মনে করি- পুরনো কোনো ঘটনাও যদি সামনে আসে, মামলা করে বিদেশ থেকে টেনে এনে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ছাত্র সংগঠন এআইএসএ-এর নেত্রী সায়নী সাহা বলেন, আমরা কানাঘুষা শুনতে পাই যে, হোস্টেলে র্যাগিং হয়। কয়েকটা ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এসেছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ক্যাম্পাসে তো র্যাগিং সেভাবে হওয়ার ঘটনা সামনে আসেনি বা আমাদের কাছে কেউ সরাসরি অভিযোগও জানাননি। আমরা তাই র্যাগিং বিরোধী প্রচার করি, লিফলেট বিলি করি, ক্লাস ক্যাম্পেইন করি যাতে র্যাগিং হলেই সাহস করে অভিযোগ জানাতে পারেন ছাত্র-ছাত্রীরা। কিন্তু অভিযোগ না জানতে পারলে ব্যবস্থা নেব কী করে? অথচ আইন মেনে ভর্তির সময়ে র্যাগিং রোধ ফর্ম পূরণ করা বা র্যাগিং রোধ কমিটি, ক্যাম্পাসের নানা জায়গায় র্যাগিং বিরোধ কমিটির সদস্যদের নাম, ফোন নম্বর সবই দেওয়া আছে। যেকোনো ধরনের র্যাগিংয়ের শিকার হলেও ওই নম্বরগুলোতে ফোন করতেও বলা আছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পার্থ প্রতিম রায় বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং দমন স্কোয়াড বা ফর্ম পূরণ করার ব্যবস্থা সবই আছে। নীতিগত দিক থেকে কোনো ত্রুটি নেই। কিন্তু সমস্যাটা সেগুলোর বাস্তবায়নের। আমাদের উপাচার্য নেই, তিনটে বিভাগের পূর্ণ সময়ের ডিন নেই, একজন মাত্র প্রো ভাইস চ্যান্সেলর। আবার এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল, ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল, কোর্ট (বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সর্বোচ্চ পরিষদ) এগুলোতে নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। এতগুলো ‘নেই’-এর ফলে র্যাগিং বিরোধী নীতিগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
উল্লেখ্য, এ ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দলবেঁধে হোস্টেলে গিয়েছিলেন প্রথম বর্ষের ছাত্রদের উৎসাহ দিতে। এরপর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা করাসহ বহিরাগত বা প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের হোস্টেলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এফকে