এস্থার ইলনিস্কি ও বিল ইলনিস্কি

প্রায় সত্তর বছর একসঙ্গে, একছাদের নিচে কাটিয়েছেন বিল ইলনিস্কি ও তার স্ত্রী এস্থার ইলনিস্কি। খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক এবং দূত হিসেবে কাজ করেছেন ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যে। তারপর থিতু হন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যে। সেখানেও ৪০ বছর ধর্ম প্রচারণার কাজে আত্মনিয়োগ করেন এই দম্পতি।

সাংসারিক জীবনে পরস্পরকে সাধারণত নাম ধরে সম্বোধন করতেন না বিল ও এস্থার। স্বামীকে এস্থার ডাকতেন ‘বইয়ের পোকা’ বলে, আর স্ত্রীর নাম বিল দিয়েছিলেন মুগ্ধতা।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১ মার্চ মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বিল ও এস্থার যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, তাদের একমাত্র সন্তান সারাহ মাইলোস্কি একে দেখতে চান ঈশ্বরের অপ্রকাশিত আশীর্বাদ হিসেবে।

বার্তাসংস্থা এপিকে তিনি বলেন, ‘এটি খুবই চমৎকার, অসাধারণ ও হৃদয়গ্রাহী অনুভূতি যে তারা একই সঙ্গে বিদায় নিয়েছেন। তবে একসঙ্গে দু’জনের চলে যাওয়া আমার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমি তাদের খুব মিস করছি।’

মৃত্যুর সময় তার বাবার বয়স ছিল ৮৮ বছর, মায়ের ৯২। মার্চের শেষ সপ্তাহে তাদের ৬৭তম বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের কথা ছিল।

আরও পড়ুন: মাসিকের সময় দু’চোখ বেয়ে নামল রক্তের ধারা

বিল ইলনিস্কির জন্ম ও বেড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যের ডেট্রয়েট শহরে। ষোল বছর বয়সে বিল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ঈশ্বরের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন। সেই অনুযায়ী, পড়াশোনা করতে তিনি যান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মিসৌরির স্পিংফিল্ড শহরের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল বাইবেল কলেজে। কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই স্পিংফিল্ডের চার্চগুলোতে ধর্মীয় যাজক বা ধর্মপ্রচারকারী পদের জন্য চাকরির আবেদন করা শুরু করেছিলেন বিল এবং একটি চার্চে তার চাকরি হয়েও যায়।

যে চার্চে চাকরি নেন বিল, সেখানে ধর্মীয় সংগীতের জন্য একজন পিয়ানোবাদকের প্রয়োজন ছিল। বিলের ওপর দায়িত্ব পড়ে চার্চের জন্য একজন পেশাদার পিয়ানোবাদক খুঁজে বের করার। সেই সূত্রেই বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে এস্থার শাবাজের সঙ্গে পরিচয় হয় বিলের। তারপর বন্ধুত্ব-পরিণয় এবং বিয়ে। এস্থার শাবাজ ছিলেন ইন্ডিয়ানা রাজ্যের মেয়ে। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইন্ডিয়ানার গ্যারি শহরে।

আরও পড়ুন: সাড়ে ৫ বছর বয়সে বিশ্বের কনিষ্ঠতম মা

সারাহ মাইলোস্কি বলেন, ‘যখন আমার বাবা আমার মাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, তিনি বলেছিলেন— আমি তোমাকে খুব বেশি অর্থ-সম্পদ হয়তো দিতে পারব না, কিন্তু একটি আনন্দময় ও উত্তেজনাপূর্ণ দাম্পত্যজীবন উপহার দিতে পারব।’

‘এবং তিনি তার কথা রেখেছিলেন। আমার নিজের চোখে যতটুকু দেখেছি— তাদের জীবন সত্যিই উত্তেজনায় পরিপূর্ণ… আর এমন সুখী দম্পতি আমি জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি।’

সেন্ট্রাল বাইবেল কলেজ গ্র্যাজুয়েশনের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই এস্থারকে বিয়ে করেছিলেন বিল। ডিগ্রি লাভের পর মিসৌরির মিডওয়েস্টে একটি চার্চে চাকরি নেন তিনি। তারপর ১৯৪৯ সালে ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরবর্তী দ্বীপদেশ জ্যামেইকাতে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে যান বিল ও এস্থার ইলনিস্কি এবং সেখানকার পরিবেশ ও মানুষজনদের প্রেমে পড়ে যান। প্রায় এক দশক জ্যামেইকাতে ছিলেন এই দম্পতি; দেশটির মনটেগো অঞ্চলে একটি চার্চ পরিচালনা করেছেন।  

জ্যামেইকাতে থাকা অবস্থায়ই মিয়ামির একটি অনাথ আশ্রম থেকে সারাহ মাইলোস্কিকে দত্তক নিয়েছিলেন এই দম্পতি। তখন তার বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। তারপর ১৯৬৯ সালে জ্যামেইকা থেকে লেবাননে পাড়ি জমান এস্থার-বিল এবং তাদের কন্যা সারাহ। সেখানে দেশটির রাজধানী বৈরুতে একটি কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নেন বিল ইলনিস্কি, অন্যদিকে একটি জনসংযোগ কার্যালয়ে চাকরি নেন এস্থার, পাশাপাশি গড়ে তোলেন একটি খ্রিস্টান রক ব্যান্ড দল।

আরও পড়ুন: ভারতে স্ত্রীর যৌনাঙ্গ সেলাই, গ্রেফতার স্বামী

সারাহ মাইলোস্কি বলেন, ‘সেসময় লেবানন ছিল একটি চমৎকার, ঝলমলে একটি দেশ।’

কিন্তু ১৯৭০ সালের পর থেকে লেবাননে বসবাসকারী খ্রিস্টান ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যার পরিণতিতে ১৯৭৫ সালে দেশটিতে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। রাজধানী বৈরুত হয়ে ওঠে অন্যতম যুদ্ধক্ষেত্র। সারাহ জানান, বৈরুতে যে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে তারা থাকতেন, তার নিচে দু’বার বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। তার বাবা একদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে কলেজে আটকা পড়েছিলেন একবার, টানা প্রায় দু’দিন বাড়ি ফিরতে পারেননি।

‘আমার মা আশঙ্কা করছিলেন— বাবা বেঁচে আছেন কি না। সেদিন আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের আশপাশের এলাকায় গোলাগুলি হচ্ছিল; মা আর আমি গোটা রাত বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। আমরা কাঁদছিলাম আর প্রার্থনা করছিলাম। পরের দিন সকালে দেখি, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের দেয়ালগুলোতে বেশ কয়েকটি বুলেটের গর্ত।’

১৯৭৬ সালে মার্কিন মেরিন সেনাবাহিনী যখন লেবাননে বসবাসকারী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করে, তাদের একটি উড়োজাহাজে দেশে ফিরে আসেন বিল, এস্থার এবং সারাহ। দেশে ফেরার অল্প কিছুদিন পর ফ্লোরিডার পাম বিচ শহরের ক্যালভেরি চার্চ, যা পরে লাইটহাউস ক্রিশ্চিয়ান সেন্টার ইন্টারন্যাশনাল হিসেবে পরিচিতি পায়, সেখানে যাজক হিসেবে যোগ দেন বিল ইলনিস্কি; তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠা করেন ‘এস্থার নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি সংস্থা। শিশুদেরকে ধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞান দেওয়া ও প্রার্থনা শেখানোর কাজ করত সংস্থাটি।

আরও পড়ুন: ভাইরাল তরুণী বাইকার আসলে একজন পুরুষ

বিল ইলনিস্কি যখন ক্যালভেরি চার্চে যোগ দেন, তখন সেখানকার জুনিয়র ছাত্র ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা শহরের অবসরপ্রাপ্ত ধর্মযাজক টম বেল্ট। বিল ইলনিস্কি সম্পর্কে তিনি এপিকে বলেন, ‘তিনি খুবই অমায়িক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। অন্যদের সহজে বিশ্বাস করতেন এবং খুবই ক্ষমাশীল ছিলেন।’

বছর তিনেক আগে বার্ধক্যজনিত শারীরিক অসুস্থতার কারণে কর্মজীবন থেকে অবসর নেন বিল ইলনিস্কি। বয়সজনিত কারণে কিছুটা স্মৃতিভ্রংশ বা স্মৃতি শক্তির দুর্বলতা (ডিমেনশিয়া) দেখা দিয়েছিল তার মধ্যে। তবে এস্থার ইলনিস্কি তার সংস্থাটি চালিয়ে গেছেন।

গত বছর যখন করোনা মহামারি দেখা দেয়, এস্থার তখন বাড়িতেই ছিলেন, তবে বিল প্রায়ই সে সময় অস্থিরতা বোধ করতেন। এমনকি মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে বেরও হতেন তিনি। সারাহ বলেন, ‘ঘরে বন্দি হয়ে থাকা বাবা একদমই পছন্দ করতেন না। মানুষের সঙ্গ বরাবরই খুব প্রিয় ছিল তার।’

এস্থার ইলনিস্কির জন্মদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক ভালবাসা দিবসের দিন। চলতি বছর মায়ের জন্মদিনে সারাহ মাইলোস্কি ও তার স্বামী শেষ এই দম্পতির সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটিয়েছেন। তারপর ২৭ ফেব্রুয়ারি উভয়েরই করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। পাম বিচে যাজকদের হাসপাতাল ট্রাস্টব্রিজে হাসপাতালের বিশেষ অনুমতিক্রমে বিল এবং এস্থার দুজনকে একই কেবিনে রাখা হয়।

আরও পড়ুন: উপাচার্যের ঘুমের সমস্যা হওয়ায় কমলো মসজিদের মাইকের শব্দ

মার্চের এক তারিখ সকাল সোয়া দশটায় মারা যান এস্থার ইলনিস্কি। তার পনের মিনিট পর সাড়ে দশটার দিকে স্ত্রীকে অনুসরণ করেন বিল ইলনিস্কি। ট্রাস্টব্রিজ হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা জ্যাকুলিন লোপেজ ডেভাইন বলেন, তার ১৫ বছরের কর্মজীবনে এই প্রথম এরকম ঘটনা দেখলেন তিনি।

বাবা-মার অন্তিম মুহূর্তে হাসপাতলে ছিলেন সারাহ। কাঁচের জানালা দিয়ে দেখছিলেন তাদের। তিনি বলেন, ‘তাদের দেখে মনে হচ্ছিল, তারা ঘুমিয়ে আছেন। মারা গেছেন— এটা প্রথম দিকে আমি মানতেই চাইছিলাম না। আমার জন্য খুবই কষ্টকর মূহুর্ত ছিল সেটা।’

‘সারাক্ষণ, সবসময় তারা একসঙ্গে ছিলেন। মৃত্যুও তাদের ভালবাসার বাঁধন ছিন্ন করতে পারেনি।’

সূত্র: এপি

এসএমডব্লিউ