বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলে রোববার (১৪ মে) প্রবল শক্তি নিয়ে আঘাত হানতে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এ ঘূর্ণিঝড়টির কারণে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

২০১৭ সালে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর দমন-নিপীড়ন থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষ বাংলাদেশে আসে। এরপর তাদের কক্সবাজারে থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন শুক্রবার (১২ মে) ঘূর্ণিঝড় মোখা ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে সংবাদমাধ্যমটি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কী হবে? কারণ শরণার্থী ক্যাম্পে যারা রয়েছে তাদের বেশিরভাগই বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে তৈরি করা ঘরে থাকে।

রোহিঙ্গারা খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্যাম্পে বিপর্যয়কর ও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে রোহিঙ্গা ও দাতব্য সংস্থাগুলো।

জাতিসংঘের রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলার প্রধান সমন্বয়ক অর্জুন জৈন সংবাদমাধ্যমটিকে জানিয়েছেন, সবকিছু মাথায় রাখা হচ্ছে। শরণার্থীদের প্রয়োজনে ভাসমান স্বাস্থ্যকর্মী এবং কয়েক ডজন অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিশেষভাবে বৃদ্ধ, শিশু ও শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য প্রশিক্ষিত দলকে মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া অসুস্থদের সরিয়ে ফেলার কাজ হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন>>>ঘূর্ণিঝড় মোখা : বাড়ছে গতি কমছে দূরত্ব 

তবে জাতিসংঘের এ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা যেসব বাড়ি-ঘরে বাস করেন সেগুলো ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন বাতাসেই উড়ে যেতে পারে। কিন্তু মোখা আঘাত হানার সময় বাতাসের গতিবেগ এটিকে ছাড়িয়ে যাবে।

তিনি বলেছেন, ‘গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গারা যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছেন, আমরা মনে করছি এ ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব আগেরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি হবে। এ মুহূর্তে আমরা জানি না ঘূর্ণিঝড়টি কোথায় আঘাত হানবে এবং এটির শক্তি কেমন হবে। আমরা ভালোর প্রত্যাশা করছি কিন্তু খারাপের জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছি।’

তিনি আশঙ্কা করেছেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে শরণার্থী শিবিরের নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হতে পারে।

এছাড়া ভাসানচরে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছেন তাদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলো।

আরও পড়ুন>>>‘মোখা দেখতে’ কুয়াকাটায় এসেছেন তারা

অপরদিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান শনিবার (১৩ মে) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংবাদমাধ্যমটি এ ব্যাপারে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র ওলগা সারাদোরর সঙ্গে কথা বলে।

জাতিসংঘের এ কর্মকর্তা গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, শরণার্থী শিবির থেকে কিছু মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে লাখ খানেক মানুষকে গরম খাবার ও জেরিক্যান দেওয়া হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, তারা ৩৩টি ভাসমান মেডিকেল দল ও ৪০টি অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন করেছে। এছাড়া জরুরি অস্ত্রোপচারের যন্ত্রাংশ ও কলেরার ওষুধ শরণার্থী শিবিরে দেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেও ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইনের ওপর দিয়েই মূলত যাবে ঝড়টি।

আরেক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিও ঘূর্ণিঝড়ে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কারণে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবির থেকে বের হতে দেয় না। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেও তাদের শরণার্থী শিবিরেই থাকতে হচ্ছে।

বিবিসি মোহাম্মদ রফিক নামে ৪০ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে। রফিক জানান, তিনি পরিবার নিয়ে বাঁশ ও তেরপলের তৈরি ঘরে থাকেন। এখন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে নিজেদের জীবন নিয়ে তারা শঙ্কিত। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এখন যা করতে পারি তা হলো আল্লাহর কাছে দোয়া করা। নিরাপত্তার জন্য আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, কারও কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা আগে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। অতীতেও আমাদের ঘর ধ্বংস হয়েছে। আমরা আশা করি এবার এমনটি হবে না।’

আরও পড়ুন>>>ঘূর্ণিঝড় মোখা : যেসব নম্বরে কল করলে সেবা দেবে পুলিশ

আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হবে। যার কারণে ভূমিধসের ঘটনা ঘটতে পারে। আর রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘরগুলো পাহাড়ে হওয়ায় ভূমিধসে ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা আরও বেড়েছে।

তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা মোহাম্মদ সামসুল দৌজা বিবিসিকে জানিয়েছেন, চাইলেও রোহিঙ্গাদের অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেছেন, ’১০ লাখ রোহিঙ্গাকে অন্যত্র সরানো খুবই কঠিন কাজ। আমাদের বাস্তবিক হতে হবে। আমাদের পরিকল্পনা হলো জীবন বাঁচানো। আমরা ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী দিনগুলো নিয়েও ভাবছি। অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা ও ভূমিধসও হতে পারে। যেগুলোও বড় ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে।’

বিবিসির প্রতিবেদনে জানানা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপকূলের কাছে থাকা মানুষ সরে গেছেন। শুক্রবার রাত থেকেই সেখানকার অলি-গলি নিরব হয়ে গেছে।

সূত্র: সিএনএন, দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি

এমটিআই