জাতিসংঘের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে আরও ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করছে ইরানে ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থী সরকারের প্রশাসন। বুধবার রাজধানী তেহরানের নিকটবর্তী শহর কারাজের দু’টি কারাগারে করাগারে এই ৭ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।

ইরানের বিচার বিভাগভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল মিজান অনলাইনের বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা জানিয়েছে, আগের দিন বুধবার কারাজের ঘেজাল হেসার কারাগারে ৩ জন এবং রাজাই শাহার কারাগারে ৪ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। রাজাই শাহার কারাগারে যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে— তারা ধর্ষণ মামলার আসামি ছিলেন; আর ঘেজেল হেসার করাগারে দণ্ড কার্যকর হওয়া আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মাদক পাচারের।

এর আগে সোমবার ধর্মবিরোধীতার (ব্লাসফেমি) অভিযোগে তেহরানের কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ২ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল ইরানের বিচার বিভাগ। পশ্চিম এশিয়ার শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশটিতে ধর্মবিরোধিতার কারণে কারো মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা ও তা কার্যকর হওয়া বেশ বিরল।

সোমবারের ওই ঘটনার পর মঙ্গলবার ইরানের ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থী সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘণের দায়ে অভিযুক্ত করে সতর্কবার্তা দিয়েছিল জাতিসংঘ। সেই সতর্কবার্তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরও ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করল দেশটির বিচারবিভাগ।

ইরানে সক্রিয় নরওয়েভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ইরান হিউম্যান রাইটস (আইএইচআর) বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে গত এই নিয়ে গত ১২ দিনে ৬৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন শহরের কারাগারে।

বিবৃতিতে আইএইচআরের পরিচালক মাহমুদ আমিরি মোগাদ্দেম বলেন, ‘জনগণকে ভীতির মধ্যে রাখতে ইরানের ক্ষমতাসীন সরকার ধীরে ধীরে নিজেকে কিলিং মেশিনে রূপান্তর করছে এবং সরকারের মূল শিকার হলো সমাজের সবচেয়ে দুর্বল লোকজন।’

মাদক পাচারের অভিযোগে ঘেজেল হেসার কারাগারে যখন ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, তার আগে কারগারটির সামনে বিক্ষোভ করছিলেন আসামিদের পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কারারক্ষীরা লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেন।

আইএইচআরের ওয়েবসাইটে সেই ভিডিওচিত্র পোস্ট করা হয়েছে। ভিডিওতে গুলির শব্দও শোনা গেছে। আইএইচআর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের লাঠিচার্জে আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর এবং তিনি এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

‘মৃত্যুদণ্ড যখন অস্ত্র’

১৯৭৯ সালে তথাকথিত ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ইসলামপন্থী সরকার জনগণের যে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে। আর সেই ‘হুমকি’ মোকাবিলায় তাদের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছে ‘মৃত্যুদণ্ড’। গত বছর দেশটির নীতিপুলিশের হেফাজতে ২২ বছরের তরুণী মাশা আমিনির গুরুতর আহত হওয়া এবং তার জেরে মৃত্যুর পর ইরানে যে অভূতপূর্ব জনবিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তা দমনে এই ‘অস্ত্রের’ ব্যাপক অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে ইসলামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে।

আইএইচআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইরানের বিভিন্ন কারাগারে অন্তত ৫৮২ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যা ২০১৫ সালের পর সর্বোচ্চ। আগের বছর ২০২১ সালের গোটা বছরে ৩৩৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল দেশটিতে।

তবে চলতি বছর এক্ষেত্রে বিগত সব রেকর্ড সম্ভবত ভেঙে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। কারণ আইএইচআরের হিসেব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ইরানজুড়ে অন্তত ২১৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের শীর্ষ নির্বাহী ভলকের টার্ক মঙ্গলবার এক বার্তায় বলেন, চলতি বছর প্রতি সপ্তাহে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ইরানে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ইরানের ইসলামপন্থী সরকারের এ পদক্ষেপকে ‘ঘৃণ্য, জঘন্য’ বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

এসএমডব্লিউ